২৪ ফেব্রুয়ারি। একটু রাত করেই পিঠ রেখেছিলাম বিছানায়। হঠাৎ বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে উঠলাম। চোখ কচলাতে কচলাতে হাত রাখলাম মোবাইল ফোনে। দেখি ভোর ৫টা ২০। ইউক্রেনে আমি ৫ বছর। পুরো সময় কিয়েভে। কিন্তু এ রকম ভয়ঙ্কর, পিলে চমকানো মৃত্যুনিনাদ শুনিনি। আচমকা ছ্যাত করে উঠল বুকটা, হামলা কী তাহলে শুরু হয়ে গেছে! আবার হাতে নিলাম মোবাইল ফোন। ঢুকলাম ফেসবুকে। হ্যাঁ! কদিন থেকেই মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো শঙ্কাটাই সত্যি হলা। হামলা করেছে রাশিয়া। পলকে ঘুম উড়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে ফোন করলাম পরিচিত কয়েকজনকে। আরেকটু আলো চড়তেই নেমে এলাম অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তায়। ঠিকঠাকই আছে সব। আগের মতোই। হামলা হয়েছে কিয়েভ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের ব্রোভ্যারি জেলায়।
কিয়েভের ঘুম ভাঙে একটু দেরিতেই। কিন্তু সে দিনটা ছিল আলাদা। ঝড়ের দিনে বাজ পড়লে যেমন হয়! সবাই কেমন উশকোখুশকো। দিশেহারা উদভ্রান্ত। চোখে-মুখে আতঙ্ক। এক হাতে ব্যাগ-লাগেজ-ট্রলি। অন্য হাতে চামড়ায় বাঁধা প্রিয় কুকুরের শেকল! আমিই কি তাহলে দেরি করে ফেলছি! দৌড়ে ছুটলাম অ্যাপার্টমেন্টে। গোছাগাছ সারতে সারতেই ফোন দিলাম আরও কয়েকজনকে। সকাল তখন ৮টা। ব্যাংকে গিয়ে জমানো টাকা সব তুলে ফেলি। তারপর বাস, ট্রেন ও ট্যাক্সির খোঁজ শুরু করি। সীমান্তে যাওয়ার জন্য। দেখি সবকিছুরই অনলাইন সেবা বন্ধ। রেলস্টেশনে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল। ৫ বছরে এমন দৃশ্য দেখিনি। গিজগিজ করছে মানুষ। স্টেশন নয়-যেন মানুষের হাট। সাদা-কালো-বাদামি নানা বর্ণের নানান দেশের মানুষ। ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিচ্ছে সীমান্তবর্তী শহর লাভিভের দিকে। আমিও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে লাভিভের পথেই রওনা হই ট্যাক্সিতে। সেখান থেকে যাব পোল্যান্ড সীমান্তে।
লাভিভ থেকে পোল্যান্ড সীমান্ত ৯০ কিলোমিটার। রাস্তায় শুধু ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার। ভয় হলো শেষ পর্যন্ত যেন জ্যাম না বেঁধে যায়। সেটাই ঘটল। ৫০ কিলোমিটার পর আর যেতে পারলাম না। নেমে পড়তে হলো। সামনের ৪০ কিমি. পুরোটাই জ্যাম! অথচ ওপাশের ফেরার লেনটা একেবারে ফাঁকা-সুনসান। বাকিদের মতো হাঁটা শুরু করলাম আমরাও। আমি তখন ৪৭ ‘শরণার্থীর’ একটি দলে। ৪০ কিলোমিটারের পথ। সঙ্গে খাবার নেই। রাস্তায় দোকানপাট নেই। চা-কফির রেস্তোরাঁও নেই। প্রচণ্ড ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছে বোতলের পানি! মাঝেমধ্যে দু-একটা চ্যারিটি সংস্থার খাবার ভ্যান দেখা যাচ্ছে কিন্তু ক্ষুধার্থের তুলনায় তা ছিল নিতান্তই সামান্য। হাঁটতে হাঁটতে অসুস্থ হলে বা পা লেগে গেলেও দাঁড়ানোর উপায় নেই-পেছনে যে হাজারো মানুষ। আমরা যখন পোল্যান্ড সীমান্তের খুব কাছে (লাভিভের শেষপ্রান্তের ওই জায়গার নাম এম-১১, পোল্যান্ডে মেদিকা) তখন দেখি ওখানে ৩০ হাজার মানুষ (আনুমানিক) আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। বেশিরভাগই ইউক্রেন নাগরিক। অন্য দেশেরও ছিল। সেখান থেকে গাড়িতে করে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
অনেক লম্বা সারি। সীমান্তে ৮টা চেকপোস্ট বসিয়েছে ইউক্রেন সেনাবাহিনী। প্রতি সেক্টরে ৫-৭ হাজার মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে সবখানেই। প্রকৃতির চাপ এলেও সরার উপায় নেই লাইন থেকে। একবার জায়গা ছাড়লেই আবার সবার পেছনে!
লাইন এগোচ্ছে না কেন? আমাদের কী পার হতে দেবে না? এ মৃত্যুপুরীতেই কি থেকে যেতে হবে আমাদের-এসব নানা শঙ্কায় লাইনে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে অনেকেই। সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর লাঠিচার্জ! প্রতিটি পোস্টেই পরিচয়পত্র দেখছে সবার। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি ইউক্রেনীয় পুরুষদের পার হতে দিচ্ছে না। আমার চোখের সামনে যে কয়েকজন যুবক ও মধ্যবয়স্ক পুরুষকে ওপারে যেতে দিল-তাদের প্রত্যেকের কাছেই অসুস্থতার (মেডিকেল) সনদ ছিল।
এই ৮ চেকপোস্ট পার হতে আমাদের লাগে পুরো একটা দিন! পরের রাতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় জিরো পয়েন্টে। সেখানেও দীর্ঘ লাইন, বিশৃঙ্খলা। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে আমাদের বের হতে আরও একদিন লেগে যায়। শেষমেশ যখন সীমান্ত পার হলাম তখন রাত দুইটা। নো ম্যান্স ল্যান্ড পার হয়ে পোল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছাতেই শুনি এখানেও ৩ চেকপোস্ট। প্রতি পোস্টেই আফ্রিকান লোকদের সঙ্গে পোল্যান্ড সেনাদের বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। নির্ঘুম ক্লান্ত ক্ষুধার্থ শরীরে সেখানেও কেটে যায় আরেকটি রাত! হাড় কাঁপানো শীত, শুকনা খাবার বা পানি কিছুই ছিল না। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার তাগিদে বিগত কোনো রাতই ১ ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারিনি। যেটুকু ঘুমিয়েছি সেটুকুও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ঘুমের ঘোরে পড়ে যেতাম হাঁটু ভেঙে। ঘুম ভেঙে যেত। ঘুমচোখে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মাথার ক্যাপকে মনে হতো জাহাজের মতো দুলছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৮টায় আমরা পোল্যান্ড সীমান্ত পার হই। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে সেই রাতটাও সেখানে পার করে দিলাম। ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে আমি সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসের লোকাল কাউন্সিলর অনির্বাণ নিয়োগীর সঙ্গে দেখা করি। স্যার তখন আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাসের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করতে বলেন। শুধু পানি খেয়ে কাটানো ৪ দিন পর দূতাবাসের দেওয়া শুকনো খাবার মুখে দিলাম!
আমি স্যারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ শুরু করলাম। যারা ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে আসছে তাদের খাবার খাওয়ানো, তাদের রাজধানীতে পাঠানো-সব কাজ দূতাবাস থেকে করা হচ্ছিল। সেসবে সহযোগিতা করছিলাম। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করি। তাদের সমস্যাগুলো শুনি এবং তাদের ডকুমেন্টসের কোনো সমস্যা থাকলে সেটা স্যারকে দিয়ে সমাধান করি। কিছু বাংলাদেশির পাসপোর্ট না থাকার কারণে তাদের পোল্যান্ড বর্ডার গার্ড ক্যাম্পে নিয়ে যায়। অনির্বাণ স্যার ক্যাম্পে গিয়ে তাদের শনাক্ত করে। তারপর পোল্যান্ড বর্ডার গার্ড তাদের রাজধানীতে বাসস্টপেজে ছেড়ে আসে। পোল্যান্ড বর্ডার গার্ড অনেক দেশের মানুষকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়-যাদের ডকুমেন্ট নেই।
স্যারের সঙ্গে মাহবুব স্যার দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ড বাংলাদেশ নাগরিকদের বাংলাদেশ দূতাবাস সব সময় সহযোগিতা করছে। আমি চার দিন ধরে দূতাবাসের হয়ে কাজ করে আসছি। বর্তমান ইউক্রেনে কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি জেলে আছে-তাদের মুক্তির জন্য স্যার কাজ করছেন।
এখনো আমরা পোল্যান্ডের বর্ডারে অবস্থান করছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো-ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডের এ সফরে আমরা পোশাক পরিবর্তন করতে পারছি না কেউই। প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমাদের কোনো গরম জায়গা নেই। কাপড় ছেড়ে আরেক কাপড় পরতে গেলেই বরফ হয়ে যাবে শরীর। আমি আজ ১০ দিন হলো এক কাপড়ে!
রায়হান হোসেন : বাংলাদেশ দূতাবাসের স্বেচ্ছাসেবক, মেদেনা (পোল্যান্ড সীমান্ত)