নজরুল মিন্টু:
উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে আজকাল ‘বাটপার’দের রাজত্ব চলছে। টরন্টোর জনাকীর্ণ সড়ক, নিউ ইয়র্কের বহুজাতিক জনসমুদ্র কিংবা মন্ট্রিয়লের বহুসাংস্কৃতিক আবহ কিংবা মিশিগানের প্রাণবন্ত অভিবাসী সমাজ, বাফেলোর উদ্যমী অভিবাসী জনপদ ও আটলান্টার বর্ণিল কমিউনিটি পরিমণ্ডল—সবখানেই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে একদল মুখোশধারী মানুষ। এরা কমিউনিটির বিশ্বাসকে পুঁজি করে, উৎসব-অনুষ্ঠানের নামে সজ্জিত মঞ্চ দাঁড় করায়, আড়ম্বরপূর্ণ বিজ্ঞাপন ছাপে, ব্যানার টাঙ্গায়, কিন্তু পর্দার আড়ালে চলে অর্থলুণ্ঠনের নানান কৌশল।
এসব বাটপারেরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে আদম ব্যাপারি, বিভিন্ন অখ্যাত ব্যক্তিদের বিখ্যাত বানানোর আশ্বাস, চাপাবাজি, মিথ্যাচারিতা, মানুষ ঠকানোসহ কমিউনিটিতে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে।
এক সময় বাংলাদেশ কমিউনিটির অনুষ্ঠান মানেই ছিল মিলনমেলা—শিল্প-সংস্কৃতির রঙ, ঐতিহ্যের আলো আর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার আবহ। আজ সেই আড্ডাঘেরা উৎসবের জগৎ ঢেকে গেছে অভিযোগের কালো মেঘে। নানা সংগঠনের নামে দোকান খুলে তারা আয়োজন করছে বড় বড় অনুষ্ঠান, প্রলোভন হিসেবে আনছে তারকা শিল্পীদের। অথচ তাদের মূল উদ্দেশ্য একটাই—প্রতারণা আর বিপুল অর্থহাতানো। তাদের চোখে কেবল ডলার, আর ডলার।
সম্প্রতি টরন্টোতে অনুষ্ঠিত ‘টেস্ট অব বাংলাদেশ’ নামে যে স্ট্রিট ফ্যাষ্টিভ্যাল হয়ে গেছে এ আয়োজন নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে। যদিও অনুষ্ঠানের আহবায়ক হিসেবে রয়েছেন শহীদুল খন্দকার টুকু এবং চেয়ারম্যান হিসেবে লেখা হয়েছে সৈয়দ শামসুল আলমের নাম; তবে এর প্রধান আয়োজক হচ্ছে রাসেল রহমান ও তার স্ত্রী আইরিন সুলতানা (তাদের নামেই কোম্পানীর রেজিষ্ট্রেশন)।
এ আয়োজনে সহযোগি হিসেবে দেখা যায় এক কুখ্যাত লুটেরার কেয়ার টেকার হিসেবে নিয়োজিত মোহিত ইসলাম নামে এক ব্যক্তি (যার পরিচয় এবং তার চাঞ্চল্যকর কর্মকান্ড ভিন্ন একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে)। আর এ আয়োজনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যার নাম ছাপা হয়েছে তিনি হলেন উত্তর আমেরিকার ‘বাটপার শিরোমনি’ হিসেবে খ্যাত দারা আবু জুবায়ের। আয়োজক এবং এর সহযোগিরা তারই সুযোগ্য শিষ্য।
পোষ্টারে উল্লেখ করা হয়েছে এ আয়োজনটির স্পন্সর করেছে কানাডা সরকার, অন্টারিও সরকার ও টরন্টো সিটি কর্পোরেশন (সংযুক্ত পোষ্টার দ্রষ্টব্য)। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি কোনো আয়োজনে তিন তিনটি সরকারি ফান্ড বা অনুদান পাওয়া গেছে।
তবে বাংলাদেশ কমিউনিটির নাম ভেঙে আয়োজকেরা কত লক্ষ ডলারের অনুদান সংগ্রহ করেছেন—তা শুধু সাধারণ মানুষই নয়, বরং কমিটির অনেক সদস্যও জানেন না। জনসমক্ষে কিংবা গণমাধ্যমে এর কোনো সঠিক হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। পোস্টার-ব্যানারে সরকারি লোগো দেখেই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন শুধু অর্থের নয়, প্রশ্ন আমাদের কমিউনিটির সম্মান, মর্যাদা ও স্বচ্ছতার।
জানা যায়, এ আয়োজনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানীর কাছ থেকে আয়োজকরা লক্ষাধিক ডলারের স্পন্সর নিয়েছেন। আরও জানা যায়, বিশেষ অতিথির সম্মানে সম্মানিত করার কথা বলে অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক হাজার ডলার নেয়া হয়েছে। ব্যক্তি বিশেষের এ ধরনের বিতর্কিত আয়োজনে রাষ্ট্রিয় সংস্থা বাংলাদেশ বিমানও স্পন্সর করেছে।
শোনা যায়, মঞ্চে যারা চেহারা দেখাতে উঠেছেন, বক্তব্য রেখেছেন তাদের কাছ থেকেও বিরাট অঙ্কের অর্থ নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কমিউনিটিতে পরিচিতি পাওয়ার জন্য, বিখ্যাত হওয়ার জন্যে এসব উৎসাহীরা অর্থ প্রদান করে বক্তৃতা দিয়েছেন।
এ যেন এক ধরনের চাতুর্যমণ্ডিত ব্যবসা। বক্তৃতা করার বিনিময়ে অর্থ, সম্মাননা দেওয়ার নামে অর্থ, ক্রেস্ট দেয়ার নামে অর্থ, এমনকি পোস্টারে মুখ ছাপানোর জন্যও অর্থ। সম্মানের জায়গাটিকে নগদে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে কী নির্লজ্জ ভঙ্গিতে। এই নৈতিক অবক্ষয়ই সবচেয়ে ভয়ংকর।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্ট্রিট ফেষ্টিভ্যাল নিয়ে নানান অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। জানা যায়, শিল্পী-কুশলীদের প্রতিশ্রত সম্মানী দেয়া হয়নি; ভেন্ডরদের প্রতিশ্রত সুবিধা দেয়া হয়নি; অব্যবস্থাপনায় অনেক ভেন্ডর তাদের মালামাল হারিয়েছেন; অনেক অংশগ্রহণকারী তাদের ব্যাগ, ওয়ালেট হারিয়েছেন; স্পন্সরদের প্রতিশ্রতি অনুযায়ী সুযোগ দেয়া হয়নি ইত্যাদি।
মানুষ জানতে চায়— দুইদিনব্যাপী এতবড় আয়োজন করে কমিউনিটি কি পেয়েছে?
আশা করি, এ আয়োজনের সাথে যারা জড়িত আছেন তারা উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন এবং যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা জনসমক্ষে তুলে ধরবেন।
সবশেষে স্পন্সরদের প্রতি সরল প্রশ্ন—আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলুন—এই আয়োজনকে স্পন্সর করে কি সঠিক কাজ করেছেন? কমিউনিটির আস্থা ও সুনামের প্রশ্নে আপনাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তাই আপনাদের প্রতি আন্তরিক আহবান—বাটপারদের পৃষ্ঠপোষকতা না করে প্রকৃত সৃষ্টিশীল, সুস্থ বিনোদন ও ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের অংশীদার হোন।
(কানাডার বিশিষ্ট সাংবাদিক নজরুল মিন্টুর এই লেখাটি নিউইয়র্কের সাংবাদিক হাবিব রহমানের টাইম লাইন থেকে সংগ্রহ করা- সম্পাদক)