আবদুস সাত্তার আইনী : কুরবানিকে আরবি ভাষায় ‘উযহিয়্যা’ বলা হয়। ‘উযহিয়্যা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ওই পশু যা কুরবানির দিন জবাই করা হয়।
শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহতাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কুরবানি বলে।
বস্তুত হযরত ইবরাহিম আ. আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালন করতে একমাত্র প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইলকে (আ.) কুরবানি করার মতো নজির স্থাপন করে গেছেন। সেই সুন্নত পালনার্থে মুসলিম জাতি আজও কুরবানি করে থাকে।
কুরবানির তাৎপর্য হলো ত্যাগ, তিতিক্ষা স্বীকার করা এবং প্রিয়বস্তুকে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা।
নেক আমলসমূহের মধ্যে কুরবানি একটি বিশেষ আমল। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় কুরবানি করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।
কুরবানি এসব ফজিলত হাসিল করতে হলে ইবরাহিম আ. যে-আবেগ ও অনুভূতি এবং প্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে কুরবানি করেছিলেন তাই আমাদের ভেতরে ধারণ করতে হবে। রক্ত ও গোশতের নাম কুরবানি নয়; বরং আল্লাহর রাহে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার দৃপ্ত শপথের নাম কুরবানি।
কোনো বিষয় সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান না থাকার ফলে অনেক সময় তা সুচারুরূপে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না; নানা ধরনের ভুলত্রুটি ঘটে থাকে। অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিথিলতা আবার ঠিক গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায়।
আমাদের দেশে কুরবানির কার্যাবলি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কিছু ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। না-জানা ও না- বোঝার কারণে অনেকেই এই ভুলগুলো করে থাকেন। আমরা যদি এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলি এবং যথার্থভাবে কুরবানির কাজ সম্পাদন করি, তাহলে তা আমাদের জন্য হবে আরও বেশি কল্যাণকর, আরও বেশি মহিমামণ্ডিত।
১. কুরবানির পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আমাদের দেশে একটি জনপ্রিয় সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কার চেয়ে কতটুকু ভালো ও বড়ো উট-গরু-ছাগল কিনতে পারলো তা নিয়ে বেশ হৈ-হুল্লোড় হয়। যাদের টাকা বেশি তারা এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকেন এবং জিততে না পারলে বেশ মন খারাপ করেন।
আসলে আল্লাহপাকের দরবারে কার কুরবানি কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হলো বা আদৌ গ্রহণযোগ্য হলো কি না—এ-ব্যাপারে প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত।
২. কুরবানির ক্ষেত্রে নিয়তের বিশুদ্ধতা জরুরি। পশু ক্রয়ের টাকা সংগ্রহ থেকে শুরু করে পশু ক্রয় ও কুরবানির যাবতীয় কর্মকাণ্ডে নিয়তের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। গোশত খাওয়ার বিলাসিতা করার জন্য বা মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কুরবানি করলে কিছুতেই কুরবানি শুদ্ধ হবে না। কেবল অর্থ ব্যয় নয়, তার সঙ্গে হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতাও থাকতে হবে।
৩. যদি কোনো বুদ্ধিমান, প্রাপ্তবয়স্ক ও মুসাফির নন এমন মুসলমান ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তবে তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব।
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাবের মতো সম্পদের মালিকানার একবছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়; বরং যে-অবস্থায় সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়, সেই অবস্থাতে কুরবানিও ওয়াজিব। কিন্তু অনেকেই যেমন কুরবানি ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানি করেন না তেমনি অনেকে সামাজিক ব্যক্তিমূল্য রক্ষার জন্য কষ্ট করে হলেও কুরবানি করেন।
কুরবানি ওয়াজিব নয়, তারপরও অমুক কি বলবে, তমুক কি বলবে- এই দুশ্চিন্তা থেকে তাঁরা টাকা ঋণ করে হলেও কুরবানি করেন। নিজেকে ও পরিবারকে কষ্ট দিয়ে এভাবে কুরবানি করা কখনই উচিত নয়। তবে কোনো দরিদ্র মুসলমান কুরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব তবে।
৪. মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা জায়েজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানি করা বিশেষ সওয়াবের কাজ। কিন্তু কোনো বড় ব্যক্তির নামে চাঁদা সংগ্রহ করে পশু জবাই জায়েজ নয়।
‘ব্যক্তির নামে’ বলতে বোঝানো হয়েছে ব্যক্তির উদ্দেশে বা ব্যক্তির পক্ষ থেকে; ব্যক্তির নাম নিয়ে পশুটি জবাই করা হবে এমন নয়। কারণ আল্লাহপাক ব্যতীত অন্য কারো নাম নিয়ে জবাই করলে জবাইকৃত পশু হারাম বলে গণ্য হবে।
এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় একটি ফেতনা দেখা দিয়েছে—বছরের বিভিন্ন সময়ে সব শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে রাসূল সা.-এর পক্ষে কুরবানি করা এবং এই গোশত দিয়ে তবারক রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো। এভাবে পশু জবাইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাসূলের নামে কুরবানি’। কিন্তু এটা কিছুতেই জায়েয হবে না।
একে তো চাঁদার টাকা দিয়ে কুরবানি হয় না, দ্বিতীয়ত, অনেকেই গোশতা খাওয়ার ইচ্ছায় টাকা দেয়, তৃতীয়ত, এটা করা হয় কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট তিন দিনে নয়, বরং রাসূল সা.-এর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
৫. উট, গরু, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া, মহিষ- এই ছয় প্রকার পশু কুরবানি করা যাবে। ছাগল বলতে খাসি ছাড়া পাঁঠা ও ছাগিও বোঝানো হয়েছে। অনেকেই মনে করে পাঁঠার গোশত খাওয়া জায়েজ হবে কিনা। পাঁঠার গোশত খাওয়া জায়েয এবং তা কুরবানিও করা যাবে। বাংলাদেশে পাঁঠা কুরবানি করার প্রচলন না থাকলেও ভারত ও পাকিস্তানে এর প্রচলন আছে।
৬. উট, গরু, মহিষ সাতজনের নামে কুরবানি করা যেতে পারে বা সাত ব্যক্তি এতে শরিক হতে পারে। এক থেকে সাতের মধ্যে যেকোনো সংখ্যক ব্যক্তির পক্ষ থেকে উট, গরু, মহিষ কুরবানি করা যেতে পারে। তবে কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যদি কারো ভাগে এক সপ্তমাংশের কম হয় বা শরিকদের একজনও যদি গোশত খাওয়ার নিয়ত করেন বা মানুষকে দেখানোর ইচ্ছে করেন তবে সকলেরই কুরবানি নষ্ট হবে। সুতরাং কুরবানিতে শরিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি।
৭. কুরবানি কেবল নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়; নিজের অধীন সন্তান, মা-বাবা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে ওয়াজিব হওয়া হয় না। তাদের পক্ষ থেকেও কুরবানি দেওয়া আবশ্যক মনে করা উচিত নয়। তবে তাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করলে তা নফল কুরবানি হবে।
৮. বন্ধ্যা পশুও কুরবানি করা যাবে। এ ব্যাপারে কোনো কুসংস্কার থাকা উচিত নয়।
৯. কুরবানি পশু ক্রয় করার সময় শরিক গ্রহণের ইচ্ছে ছিলো না, পরে শরিক গ্রহণ করতে চাইলে ক্রেতা দরিদ্র (যার ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়) হলে পারবে না, অন্যথায় পারবে। কিন্তু ভালো কাজে নিয়ত পরিবর্তন করা ঠিক নয়।
১০. নিজের কুরবানির পশু নিজেই জবাই করা উত্তম। এই উত্তম কাজটি অনেকেই করতে পারেন না। যদিও এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। অনেকেই নিজের হাতে পশু জবাই করলে কুরবানি হবে কি-না এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। অজ্ঞতা থেকে এই সন্দেহের উৎপত্তি।
১১. নিজে জবাই না করলে বা করতে না পারলে জবাইয়ের সময় সামনে থাকা ভালো। মেয়েলোকের পর্দার ব্যাঘাত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সামনে না থাকতে পারলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে ভিড় করে দাঁড়ানো বা চিৎকার-চেঁচামেচি করা উচিত নয়।
১২. কুরবানির পশু জবাইয়ের আগে ও পরে দোয়া পড়তে হয়; কিন্তু এই দোয়া পড়া জরুরি নয়। কেবল ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেই কুরবানি হয়ে যাবে। অনেকেই মনে করেন, কুরবানির পশু জবাইয়ের আগে-পরে দোয়া পড়া অত্যাবশ্যক এবং এই দোয়া না পড়লে কুরবানি হবে না। তাদের এই ধারণা অমূলক ও বিভ্রান্তিকর।
দেখা যায়, যাকে দিয়ে কুরবানির পশু জবাই করানো হয় তার মুখ থেকে কুরবানিদাতারা এই দোয়া স্পষ্টভাবে শুনতে চান। অনেকে আবার জবাইকারী দোয়া মুখস্থ বলতে পারেন কি-না আগেভাবেই এই পরীক্ষা নেন। যিনি পরীক্ষা নেন তিনি হয়তো এই দোয়া দুটি ভালোভাবে জানেনও না।
১৩. অনেক জায়গায় দেখা যায় কুরবানির পশু জবাইয়ের জন্য শোয়ানোর সময় যারা পশুটিকে ধরেন তাঁরা এমনভাবে শক্তি প্রকাশ করেন বা আঘাত করেন যেনো তাঁরা অসুর বধ করতে যাচ্ছেন। অনেকক্ষণ ধরে রেখেও পশুকে কষ্ট দেওয়া হয়। প্রিয়বস্তু কুরবানি করার সময় এমন মনোভাব প্রকাশ বা কাজ বাঞ্ছনীয় নয়।
১৪. কুরবানির পশু ক্রয় থেকে গোশত কাটাকাটি ও বণ্টন পর্যন্ত ছবি তোলে রাখা এখন একটা মজাকর ক্রিয়াতে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ ভিডিও চিত্রও ধারণ করেন। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা সেট সবার হাতে হাতে থাকায় খুব কম কুরবানিই মনে হয় এই মজাকর ক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকে। সবাইকে মনে রাখতে হবে কুরবানি একটি মহান ইবাদত। ছবি তোলা, হইচই ও মজা করা ইত্যাদির অবকাশ এখানে নেই। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা সঙ্গে যে-কুরবানি দেওয়া হচ্ছে—এসব কর্মকাণ্ড তার বিপরীত চিত্র প্রকাশ করে।
১৫. অংশীদারগণ গোশত অনুমান করে বণ্টন করবেন না বরং বাটখারা দিয়ে ওজন করে বণ্টন করবেন। অনথ্যায় ভাগের মধ্যে কমবেশি হয়ে গেলে গোনাহগার হতে হবে। তবে অংশীদারগণ সবাই যদি সম্পূর্ণ গোশত দান করে দিতে চান অথবা রান্না করে খাওয়াতে বা বিলাতে চান তাহলে বণ্টনের প্রয়োজন নেই।
১৬. পারিশ্রমিক হিসেবে কাউকে কুরবানির পশুর গোশত বা অন্য কোনো অংশ দেওয়া জায়েজ নয়।
১৭. কুরবানির গোশত নিজে খাওয়া, পরিবারবর্গকে খাওয়ানো এবং গরিব-মিসকিনকে দেওয়া সবই জায়েজ। মুস্তাহাব ও উত্তম পদ্ধতি হলো কুরবানির গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেদের জন্য রাখা, একভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া এবং বাকি একভাগ দরিদ্রদের দান করা। তিনভাগে ভাগ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক কিছু নয় বা এভাবে বণ্টন না করলে কুরবানি হবে না তাও নয়। কিন্তু দরিদ্রদের অবশ্যই দিতে হবে, কারণ এতে তাদের হক রয়েছে।
১৮. কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে কুরবানি মান্নত করলে এবং সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে তাঁর ওপর (ধনী হোক বা দরিদ্র) কুরবানি করা ওয়াজিব। মান্নতের কুরবানির সম্পূর্ণ গোশতই গরিব-মিসকিনকে দান করে দিতে হবে।
১৯. কোনো মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে ওসিয়ত করে গিয়ে থাকলে সেই কুরবানির গোশতও মান্নাতের কুরবানির গোশতের মতো সম্পূর্ণটাই দরিদ্রদের মধ্যে দান করতে হবে। আত্মীয়স্বজন দরিদ্র হলে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২০. কুরবানির গোশত শুকিয়ে বা ফ্রিজে রেখে দীর্ঘদিন খাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। যারা মনে করেন কুরবানির গোশত তিন দিন বা সাত দিনের বেশি সময় রেখে দেওয়া জায়েয নেই তাদের ধারণা ভুল।
২১. কুরবানির পশুর চামড়া শুকিয়ে বা প্রক্রিয়াজাত করে নিজে ব্যবহার করা যায়; কিন্তু চামড়া বিক্রি করে দিলে তার মূল্য অবশ্যই দরিদ্রদের দিয়ে দিতে হবে। সরাসরি চামড়াও দান করা যায়। বিক্রি করলে যে-টাকা হাতে আসবে ওই টাকাটাই দান করতে হবে। ওই টাকা নিজে খরচ করে পরে অন্য টাকা দান করলে আদায় হবে বটে, তবে অন্যায় হবে। কুরবানির চামড়া বা তার মূল্য মসজিদ বা মাদ্রাসার নির্মাণকাজে দান করা জায়েয নয়। এটা একান্তই এতিম-মিসকিনদের হক।
২২. কুরবানির পশু ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেককেই সমালোচনায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। তারা পরচর্চাও করেন। পরচর্চা এমন এক পাপ, সতর্কতা না থাকলে এই পাপ থেকে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিরাও রেহাই পেতে পারেন না। এ ব্যাপারে সবার সতর্কতা জরুরি।
আমরা যা ইবাদত-বন্দেগি করি, সেই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানা আবশ্যক। যথাযথ জ্ঞানের অভাবে আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে ভুলগুলো এড়ানো সম্ভব হয় না।
আল্লাহপাক আমাদের যথার্থ জ্ঞান অর্জন করে ভুলত্রুটিমুক্ত সার্বিক সুন্দর ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন।