।। স ন জী ব ন কু মা র ।।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন , ”জ্ঞানের চর্চা কমছে। আমাদের জ্ঞানের সৃজনশীল চর্চা আশাপ্রদ নয়। দোষটা যে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের তা কিন্তু নয়। জ্ঞানের কদর সমাজে কমেছে। জ্ঞানে কাজ হয় না, কাজ হয় টাকায়। জ্ঞানী লোকদের সম্মান নেই, টাকাওয়ালাদের আছে।”
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথাটা যে কতটা সত্য, তা নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটিকে দেখলেই তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। এখানকার অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত অনেককেই নিজের ঢোল নিজেরা বেশ জোরেশোরে পেটান শুধু মাত্র টাকার জোরে। কখনো কখনো অন্যদের দিয়েও পেটান। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এমন বিষয় নিয়েও কথা বলেন, যা তাদের জন্য মানানসই নয়, উপযুক্তও নয়।
নিউইয়র্কের বাংগালি কমিউনিটিতে কিছুদিন আগেও প্রতারক, অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, টাউট-বাটবার, ধর্ষণে অভিযুক্ত এবং ঘৃণিতব্যক্তিদের উৎকট অত্যাচার ছিল না। আত্মপ্রচারের এই সর্বব্যাপী নোংরামো রূপটা দেখা যায়নি । এখন ধীরে ধীরে সংস্কৃতিহীন এই সব মানুষদের দাপট বাড়ছে। পদক ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তি কিংবা সম্মাননা প্রাপ্তি নিয়ে এক ধরনের হৈ চৈ করা প্রচার ইদানীংকালে অনেক বেশি বেশি চোখে পড়ছে। বাসা ভাড়া না দিয়ে বছরের পর বছর অন্যের বাড়ি দখল করে রাখা, সন্তানসহ স্ত্রীকে আলাদা করে দিয়ে নতুন বিয়ে করা, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতী, প্রতারকসহ সমাজের অপাংতেয় মানুষগুলোর ভীড় এই কমিউনিটিতে দিন দিন বাড়ছে ।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এভাবে সার্টিফিকেট,পদক কিংবা সম্মাননা প্রাপ্তির যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সেটাকে কমিউনিটির জন্য অকল্যাণকর মনে হয়। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অন্ধকার মনে হয়। বিশেষ করে এই প্রতিযোগিতায় যখন নিউইর্য়কের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক সমিতি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি জড়িয়ে পড়েন।
এখানে জ্ঞানী লোকদের সম্মান দেয়া হচ্ছে না। এখানে অর্থহীন সংস্কৃতবান মানুষরা অবহেলিত ও উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে । টাকার কাছে হার মানছে জ্ঞানের কদর। যার কারণে সমাজের ভালো মানুষগুলোও নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে অভিমান করে আড়ালে চলে গিয়েছেন।
অনেকের স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে- নিউইর্য়কের মানুষের মধ্যে এই যে আত্মপ্রচার ও আত্মতুষ্টির চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি সেটা কী বাঙালী সংস্কৃতির অংশ ? এতে করে কি কমিউনিটির মান-মর্যাদা বাড়ছে ? রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হচ্ছে ? নাকি এটা একটা নতুন বাঙালী সংস্কৃতি যা যা ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে ? তবে কি পরবর্তী প্রজন্মকে এই অন্ধ সংস্কৃতিকে ধারণ করতে হবে ? তাহলে কী আমাদের কমিউনিটির আগামী প্রজন্ম এসব তথাকথিত পদক ও সার্টিফিকেট দেখে জ্ঞানী গুণীদের সম্মান দেবে?
এর জন্য দায়ী কারা ? আমরা লক্ষ্য করছি শুধু ব্যক্তিবিশেষ নয়, সার্টিফিকেট, পদক এবং সম্মাননার ইঁদুর দৌড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ গণমাধ্যমও জড়িয়ে পড়ছে । অনুষ্ঠান আয়োজকদের বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ”টু-পয়সা” দিয়ে সবাই এখন জোর করে ’সম্মান’ কিনে নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এভাবেই হয়তো একদিন নিউইর্য়ক থেকে সত্যিকারের গুণীদের কদর কমে যাবে । নেমে আসবে বুনো অন্ধকার। আর কদর বাড়বে প্রচারসর্বস্ব ও পয়সাওয়ালা প্রতারক, অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, টাউট-বাটবার, ঘৃণিতব্যক্তি ও গোষ্ঠীদের। সেই ঢামাঢোলে বিভ্রান্ত হবে আমাদেরই সন্তান,আগামী প্রজন্ম। যা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর অন্য কিছু করার থাকবে না, যদি না আমরা এখনও এই সর্বনাশা কর্মকান্ড থেকে নিজেদের বিরত না রাখি।