সন্ধান২৪.কম : ফ্রান্সে অনেক বাংলাদেশির আশ্রয়ের আবেদন শুনানি ছাড়াই বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশিদের ফাইল প্রত্যাখ্যানের সংখ্যা ১৪০০-এরও বেশি ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। এসব বাংলাদেশিদের অভিযোগ, প্রথম দফায় আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়ার পর আদালতে আপিল করা হলেও তা শুনানি ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন ফরাসি জাতীয় আদালত (সিএনডিএ)।
জানা গেছে, চলতি বছর আদালতের আদেশের মাধ্যমে খারিজ হওয়া আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফরাসি আইনি পরিভাষায় ‘অরদোনোন্স’ হিসেবে পরিচিত এসব স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখানে বেশ উদ্বিগ্ন আশ্রয় আদালতে লড়াই করা আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা বলছেন, স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান সাধারণত ফরাসি আশ্রয় আইন অনুযায়ী যেসব দেশ আশ্রয় আবেদনের বিশেষ তালিকায় ‘নিরাপদ’ দেশ হিসেবে নথিভুক্ত তাদের ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ফরাসি সরকারের নিরাপদ দেশগুলোর তালিকায় নেই।
আশ্রয়ের আবেদন খারিজ বিষয়ে সিএনডিএ জানায়, অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে কারো আশ্রয় আবেদন অফপ্রা থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে এবং সেই আশ্রয় আবেদনে নির্দিষ্ট ও গুরুতর কোনো তথ্য ও উপাদান খুঁজে পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে শুনানিতে ডাকা ছাড়াই আদালত একটি অর্দোনোন্স বা প্রত্যাখ্যান জারি করে থাকে।
তবে ফ্রান্সের জাতীয় এ আদালতে লড়াই করা আইনজীবীদের কাছে আদালতের এই ব্যাখ্যাটি বোধগম্য নয়। বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলের আওতাধীন হউ-দ্য-সেইন বা ৯২ ডিপার্টমেন্টের বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত আইনজীবী সুহিলা নাদুর বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি দীর্ঘ আইনি সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে এ সকল অপব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। একজন ব্যক্তির বক্তব্য না শুনেই রায় দেয়ার নীতিটি আমাদের হতবাক করেছে। কারণ সেই ব্যক্তিকে ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে আশ্রয় আইনে সুরক্ষার অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে দেয়া স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান আদেশ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন আইনজীবী। তাদের মধ্যে একজন সুহিলা নাদুর। তিনি বলেন, ‘সিএনডিএতে আমি ২০ বছর ধরে আশ্রয়প্রার্থীদের হয়ে লড়ছি, আমি কখনই একজন বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীকে শুনানি ছাড়া রায় বা অর্দোনোন্স পেতে দেখি নি।
তিনি আরও জানান, ২০২১ এর শুরু থেকে আমিসহ আমার অন্যান্য আইনজীবী সহকর্মীরা বাংলাদেশিদের আবেদনের ক্ষেত্রে গণহারে অর্দোনোন্স আদেশ পেয়েছি। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রত্যাখ্যাত আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা পূরণ করতে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
আইনজীবী সুহিলা নাদুর যোগ করেন, যদিও ২০২১ সাল এখনো শেষ হয়নি এর মধ্যেই বাংলাদেশিদের ফাইল প্রত্যাখ্যানের সংখ্যা ১৪০০-এরও বেশি ছাড়িয়েছে। আইনজীবীদের ধর্মঘট ও কোভিড-১৯ জনিত লকডাউন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বারবার আদালত বন্ধ থাকায় পূর্ণ ক্ষমতায় স্বাভাবিক গতিতে আদালতের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয় নি।’
বিদেশিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আরেক আইনজীবী উদ রিমেইলহোর বলেন, ‘এর আগে আমার চেম্বারে আমি খুব কমই এ জাতীয় রায় প্রাপ্ত আবেদনকারীদের পেয়েছি। কিন্তু এই গ্রীষ্মে আমি বেশ কয়েকটি ফাইল পেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আমার চেম্বারে মাসে তিন থেকে চারটি আবেদন শুনানি ছাড়াই প্রত্যাখ্যান হচ্ছে। যা সংখ্যায় অনেক! এর আগে বাংলাদেশিদের সাধারণত অর্দোনন্স বা স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান করা হতো না, এখন সেগুলি শত শত আবেদনকারীদের দেয়া হচ্ছে।’
এ বিষয়ে ফরাসি জাতীয় আশ্রয় আদালত (সিএনডিএ)-র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইসাবেল ডেলি আইনজীবীদের উত্থাপন করা পরিসংখ্যান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনো এই বছরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু, মোট সিদ্ধান্তের বিপরীতে আদালতের স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান বা অর্দোনন্স দেয়ার হার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক হারে বেড়েছে।
যেমন ২০১৮ সালে ৩৪%, ২০১৯ সালে ৩৩.৫% এবং ২০২০ সালে ৩২% ছিল। ২০২১ শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত এটি ৩০%। অর্থাৎ বছরের শেষে এই সংখ্যায় তেমন বড় কোনো রদবদল হবে না।
এদিকে বাংলাদেশিরা বলছেন, তারা জানেন না তাদের দোষ কী? সিএনডিএ কি তাহলে বাংলাদেশিদের বিষয়ে বিচারকদের বিশেষ কোনো নির্দেশনা দিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজাবেল ডেলি বলেন, ‘না, একেবারেই না। বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীদের ‘লক্ষ্যবস্তু’ বানানোর মতো কোন উদ্দেশ্য সিএনডিএ’র নেই।’
তাহলে আইনজীবীদের উত্থাপন করা সংখ্যাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? ইনফোমাইগ্রেন্টসের এই প্রশ্নের জবাবে ইজাবেল ডেলি বলেন, ‘সম্ভবত অতীতের অভিজ্ঞতায় বিচারকদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে।
এদিকে আদালতে আশ্রয়ের আবেদন শুনানি ছাড়াই বাতিল হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশি আশ্রয় প্রার্থীরা। একাধিক বাংলাদেশি বলছেন, রাজনৈতিক কারণে ভুক্তভোগী তা প্রমাণ করার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট নথি আছে। কিন্তু নিজের সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করার সুযোগ তারা আদালতে পাননি।
এদিকে বাংলাদেশির জন্য শীত ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে আসছে। কারণ একবার আদালত থেকে আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে সাধারণত আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত বিশেষ বাসা এক মাসের মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। সিএনডিএ থেকে চিঠি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিতে হয় যা নিয়ে রীতিমত উদ্বেগে রয়েছেন বাংলাদিশিরা। সূত্র: ইনফোমাইগ্রান্টস অবলম্বনে।