ডা. জাহেদ উর রহমান : ভৌগোলিকভাবে আমাদের কাছের দেশ শ্রীলংকার দেউলিয়া হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এদেশের অনেক সাধারণ মানুষ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সচেতন হতে শুরু করেছেন। সরকারের ক্রমাগত প্রচারণায় অর্থনীতির একেবারে বেসিক জ্ঞান না থাকা একজন সাধারণ মানুষও এটা বুঝতে পেরেছিলেন, রিজার্ভ বেশি থাকা ভালো; কিন্তু এটা কমে যাওয়া একটা রাষ্ট্রের কত বড় বিপদের কারণ হতে পারে সেটা শ্রীলংকাকে দেখে মানুষ বুঝতে পারছে।
এ মুহূর্তে অর্থনীতিবিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক, অর্থনীতিবিদ, সরকার, বিরোধী দলের বক্তব্যে, এমনকি সামনাসামনি আড্ডায় এবং ফেসবুকে নাগরিকদের আলোচনার কেন্দ্রে আছে রিজার্ভ পরিস্থিতি এবং এ সংক্রান্ত সংকট। আলোচনা নানামুখী। এ মুহূর্তে দেশের রিজার্ভ আসলে কত, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আইএমএফের মতপার্থক্য আছে। আইএমএফের বক্তব্য গ্রহণ করলে (সত্যি বলতে, সেটাই যৌক্তিক) রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে, সেটা বাদ দিলে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ এটা বর্তমান আমদানির হিসাবে সর্বোচ্চ ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। আমরা সে বিতর্কে ঢুকছি না। তবে আমরা আলোচনা করব রিজার্ভের এ পরিস্থিতির পেছনে মূল কারণটি নিয়ে। বলা বাহুল্য, এ নিয়ে খুব স্পষ্ট আলাপ হচ্ছে না।
সম্প্রতি দেশে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য সংকটকে দেখাচ্ছেন সবাই। এটা ঠিক। গত অর্থবছরে দেশে মোট ৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে। ওদিকে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন। এ পার্থক্য আরও বড় হবে, কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হবে বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং কিস্তি পরিশোধের অর্থ। ক্রম হ্রাসমান রেমিট্যান্স, বৈদেশিক ঋণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) সবকিছুকে একত্র করলেও এ পার্থক্য দূর করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত আমদানি কেন? দুবছর করোনার সংকটে পড়ে মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। ব্র্যাক-পিপিআরসি এবং সানেমের মতো সংস্থা বলছে, করোনার কারণে আড়াই কোটির মতো মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। তাতে অনিবার্যভাবেই মানুষের ভোগের ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এ ছাড়াও গত বেশ কয়েক মাস ধরে দেশ উঁচু মাত্রার মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছে। এ মূল্যস্ফীতিও মানুষের ভোগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে, এটাও নিশ্চিত।
মানুষের ভোগ করার ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বিভিন্ন পণ্য, পণ্য তৈরির কাঁচামাল কিংবা পণ্য উৎপাদনকারী ‘ক্যাপিটাল মেশিনারি’ আমদানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। গত কয়েক মাসে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রবৃদ্ধির কারণে এ শিল্পের আনুষঙ্গিক আমদানি বেড়েছে নিশ্চয়ই। এ ছাড়া বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার সংকটের কারণে জ্বালানি তেলসহ নানা পণ্যের মূল্য বেড়েছে। জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে। তাতে আমদানি করা পণ্যের পরিমাণ না কমলেও আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের অঙ্ক কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু এসব তথ্য কি দেশের মাসিক আমদানি ৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে?
আমদানির এ অকল্পনীয় উল্লম্ফনের ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের টাকা পাচারের প্রক্রিয়া ও পন্থা বুঝতে হবে। টাকা পাচার দুভাবে হতে পারে-ব্যাংকিং চ্যানেলে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার হয় দুভাবে। একটি হচ্ছে আমদানির নামে। ধরা যাক, একজন আমদানিকারক ১০০ ডলার প্রকৃত মূল্যের পণ্য আমদানি করবেন। এখন তিনি সেই পণ্যের আমদানি মূল্য ১০০ ডলারের চেয়ে বেশি (১৫০ ডলার) দেখালেন। এবার তিনি যখন এ আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করলেন, তখন তিনি ৫০ ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলেই বেশি পাঠিয়ে দিতে পারলেন। এটাকে বলে ওভার ইনভয়েসিং।
এবার উলটো একটা পরিস্থিতি কল্পনা করা যাক। একজন রপ্তানিকারক ১০০ ডলার প্রকৃত মূল্যের পণ্য রপ্তানি করলেন। কিন্তু তিনি দেশে দেখালেন, রপ্তানি করেছেন ৫০ ডলারের পণ্য। তাতে তিনি তার উপার্জিত অর্থ থেকে ৫০ ডলার দেশের বাইরে রেখে দিতে পারলেন। সেই টাকা দেশে আর এলো না। এটাই হচ্ছে আন্ডার ইনভয়েসিং।
ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরেও টাকা পাচার হয় হুন্ডির মাধ্যমে। ধরে নেওয়া যাক, একজন প্রবাসী কর্মী দেশে কিছু টাকা পাঠাতে চান। তিনি সেই টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে তা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে প্রবেশ পেত। কিন্তু তার পরিবারকে যেহেতু এটা শেষ পর্যন্ত দেশীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে নিতে হবে, তাই কেউ একজন বিদেশে তার বৈদেশিক মুদ্রাটা কিনে নিয়ে দেশে তার পরিবারের কাছে বাংলাদেশি মুদ্রা পৌঁছে দেয়। যিনি টাকা পাঠান তার পরিবারের জন্য এ পদ্ধতি খুব সহজ, কারণ তারা ঘরে বসেই টাকা পেয়ে যান। এর চেয়েও জরুরি কথা হচ্ছে, এক্ষেত্রে তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা টাকার চেয়ে বেশি টাকা পান। আর সম্প্রতি ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের মূল্যের বড় পার্থক্য তৈরি হওয়ার কারণে এখন হুন্ডিতে টাকা পাঠানো অনেক বেশি লাভজনক হয়েছে। রেমিট্যান্সের পরিমাণে বিরাট একটি ভাটা তৈরি হয়ে যাওয়ার পেছনে এটাই এ মুহূর্তের কারণ।
হুন্ডির মাধ্যমে কত বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে না, তার একটা নজির আমরা করোনার সময় দেখেছিলাম। এ সংকটের মধ্যে দেশের রিজার্ভ খুব দ্রুত বেড়েছিল মূলত রেমিট্যান্সের উল্লম্ফনের কারণে। করোনার সময় অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে চলে আসার সময় তাদের সঞ্চয়সহ সব অর্থ দেশে এনেছিলেন। এ সময় বিদেশে যাওয়া যেহেতু বন্ধ ছিল, তাই বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ভীষণভাবে কমে গিয়েছিল। ফলে বিদেশে কর্মরত মানুষদের ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়া দেশের টাকা পাঠানোর আর কোনো উপায় ছিল না।
আমরা তাহলে এটা বুঝতে পারছি, হুন্ডিতে পাঠানো টাকা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; কিন্তু যেহেতু এ টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবেশ করে না, তাই এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব রাখে না। তবে আমরা এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি, নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে (ব্যাংক আর কার্ব মার্কেটে ডলারের মূল্যের পার্থক্য কমানো, ইনসেনটিভ দেওয়া) অথবা হুন্ডি (এটি অবৈধ) ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত টাকার হিসাব দেয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত হিসাবে দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে। তাদের হিসাবের মধ্যে ব্যাংকবহির্ভূত খাতের (হুন্ডি) মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ছিল না।
আমরা এ কথা অনেকেই বলছি না, বললেও বলছি খুব নিচু স্বরে যে, গত কয়েক মাসে দেশ থেকে আসলে বড় অঙ্কের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার হয়েছে। নির্বাচন কাছে এলে দেশের টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যায়, এটা আমরা জিএফআইয়ের পূর্ববর্তী রিপোর্টে দেখেছি। ২০১৪-এর নির্বাচনের আগে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছিল।
মজার ব্যাপার, ব্যাংকিং চ্যানেলের এ পাচার হওয়ার পেছনে সরকারি কিছু লোকের প্রত্যক্ষ সহায়তা ও যোগসাজশ আছে। কিছুদিন আগে জিএফআই আবার টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছে। সেখানে তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে ২০১৫ সালের আগের ডেটার ওপর নির্ভর করে। সংস্থাটি জানায়, ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার আমদানি-রপ্তানি নিয়ে তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একটি শিশুও বুঝবে এ হিসাব দেওয়া বন্ধ করার কারণ কী। অথচ কারা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার করেন, কত টাকা পাচার করেন-সব তথ্য দ্রুত বের করে ফেলার মতো প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) দেশে আছে।
এছাড়াও হুন্ডির বিরুদ্ধে সরকারের ক্র্যাকডাউন দূরের কথা, গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদক্ষেপও আমরা দেখি না। একটা এলাকায় কারা হুন্ডি ব্যবসা করেন সেটা এলাকার মানুষ জানেন, যা গোয়েন্দা সংস্থার না জানার কোনো কারণ নেই। বর্তমানে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেল ও খোলাবাজারে ডলারের মূল্যে যে ১০ টাকার মতো পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে, সেই প্রেক্ষাপটে হুন্ডির বিস্তার ঠেকিয়ে রাখা খুব কঠিন। কিন্তু এটা তো নিশ্চিত, কঠোর ব্যবস্থার মাধ্যমে এর প্রকোপ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
সরকার যখন এখন এমন সংকটে পড়েছে, যে সংকট দেশে একটা চরম অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, তখন সরকার জ্বালানিসহ নানা দিকে কৃচ্ছ সাধনের পদক্ষেপ নিয়ে সংকটকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে আমরা অন্তত এ ব্যাপারে নিশ্চিত-টাকা পাচার বন্ধ করা না গেলে অন্য পদক্ষেপগুলো কোনোভাবেই সরকারকে বড় সংকট থেকে বাঁচাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, এ দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করেন, তারা সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি অর্থাৎ অলিগার্ক। এসব অকল্পনীয় শক্তিশালী মানুষকে টাকা পাচার করা থেকে বিরত করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা সরকারের আছে বলে মনে হয় না। সত্যি বলতে, ওই অলিগার্করা সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এমন প্রশ্ন কেউ করতে পারেন-টাকা পাচারই কি রিজার্ভ সংকটের প্রধান কারণ? আমরা এমনটিই বিশ্বাস করি, তবে সেই বিতর্কে না ঢুকেও এটুকু অন্তত বলি, এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। আর সবচেয়ে জরুরি কথা-সদিচ্ছা থাকলে এ কারণটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল, যা দেশের রিজার্ভকে নিরাপদ করতে পারত।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট