লড়াকু বাঙালির বিজয়গাথা ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

 ।। সাদেকুর রহমান ।।

বর্ষা, শরৎ আর হেমন্ত পেরিয়ে শুরু হয় শীতকাল। কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে গ্রাম-বাংলাজুড়ে শীত নামে। কিন্তু শীত নেই মুক্তিকামী বীর বাঙালির। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে পরাজিত করতে দেহের রক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটছে। মূলত ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি দিনই শত্রুর পরাজয়ের ক্ষণ গণনা চলছিল। এক একটি দিনে রচিত হচ্ছিল লড়াকু বাঙালির বীরত্বগাথার নতুন নতুন ইতিহাস। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের সেসব বীরত্বগাথা ইতিহাস আমাদের নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আর্কাইভ ও বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিলের বিবরণ অনুযায়ী, ১৯৭১-এর এদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে রয়েছে ভারতীয় মিত্র বাহিনী। মুক্তি ও মিত্রবাহিনী চারদিক দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে। একের পর এক শত্রুঘাঁটির পতন ঘটিয়ে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে মুক্তাঞ্চলগুলোতে সমবেত হতে শুরু করেন।

এদিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় বিশাল সমাবেশ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার দেশের সক্রিয় সহযোগিতার ঘোষণা দেন। ইন্দিরা গান্ধীর এ ঘোষণায় স্পষ্ট হয়ে যায়, বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে ভারত। এ সংবাদে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ মানুষ খুশিতে রাস্তায় নেমে আসে। শরণার্থী শিবিরগুলো ভাসতে থাকে আনন্দের জোয়ারে।

এদিন পাকিস্তানের অনুরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যুদ্ধ বিরতি এবং পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের উভয় রণাঙ্গনে দু’দেশের সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে ‘পাক-ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ’ হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করা। বিশ্ববাসীকে বুঝাতে চেয়েছিলেন এটা ভারতীয় আগ্রাসন। যার ফলে পাকিস্তানবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করার সুযোগ পাবে। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দাবি করে যে, ‘এই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।’

এই যখন উৎকণ্ঠাময় অবস্থা তখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখিত এক পত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান।

যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করানো জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন বৈঠকের পর বৈঠক করছে। সবাই যখন চরম উদ্বেগ আর চিন্তার মধ্যে ছিলেন তখন আসল খুশির সংবাদ। ভারতের অনুরোধে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রদান করলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ভেস্তে যায়। পোল্যান্ডও এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে আরও একটি আনন্দের সংবাদ ছিল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের এই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা।

কিন্তু ভারতের অনুরোধে তদানীন্তন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবের ওপর ভেটো দেয়। সোভিয়েত ভেটোর ফলে পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত আদায়ে ব্যর্থ হয়।

এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র যখন হেরে গিয়েছিল তখন পক্ষান্তরে পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন উত্তরে চীন ও দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের জন্য সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে নি। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, ‘আমরা অনেক সহ্য করেছি। এখন শত্রুর প্রতি চরম ধ্বংসাত্মক প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে। আমাদের সেনাবাহিনী শত্রুকে কেবল আমাদের ভূখ- থেকেই বিতাড়িত করবে না, শত্রুর ভূখ-ে গিয়ে তাদের নির্মূল করবে।’ কথাগুলো ছিল তার শুধুই আস্ফালন। তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি প্রতিপক্ষকে চরম আঘাত হানা এবং সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ দেন। রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের উভয় অংশে যুদ্ধ চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় চাপ মোকাবিলা করা হচ্ছে। মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেবে বলে চীন ওয়াদা করেছে।

এদিকে, এদিন থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে- ১. পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে, ২. উত্তরাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে, ৩. পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে, এবং ৪. মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আরেকটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে। যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারাদেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানিরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড়ো করেছিল, যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকায় জোর বিমান যুদ্ধ চলে। ঢাকা ছিল পাক বিমানবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতেই ছিল তাদের জঙ্গি বিমানগুলো। পাক বিমানবাহিনীতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন (২৮টি) জঙ্গিবিমান। এক স্কোয়াড্রন চীনা মিগ-১৯, আর এক স্কোয়াড্রন মার্কিনি স্যাবার জেট। পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে মিগ-১৯ বিমানগুলো পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে থাকে শুধু স্যাবারগুলো। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তানের বিমান-বহরের প্রায় অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

এ সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি তৎকালীন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবুল আলা মওদুদী পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানকে জানান, ‘প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত হয়। যুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনায় লক্ষ্মীপুর ছিল বিপর্যস্ত। ৩নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শমশেরনগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেলস্টেশন দখল করেন। ৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন মেহেরপুর। এছাড়া ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে কামালপুর নিজেদের আয়ত্তে আনেন। এছাড়া এ দিন অদম্য মুক্তিসেনারা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, দামুড়হুদা, জীবননগর, বকশীগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকা দখলমুক্ত করেন।

 

Exit mobile version