শতভাগ বিদ্যুতায়ন গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করবে

শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলকে বাংলাদেশ; নতুন আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে দেশ। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম শতভাগ বিদ্যুতায়নের দেশ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারল। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে যেতে এটা করা জরুরি ছিল। দেশের প্রত্যন্ত দুর্গম গ্রাম যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ কঠিন, তেমন গ্রামেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ।

প্রায় সব ধরনের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত বহু পরিবার আজ বিদ্যুৎ সংযোগের বদৌলতে তাদের জীবনটাকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করছে। চারপাশ পানিতে পরিবেষ্টিত বিস্তীর্ণ বিলের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের ঘরেও জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। সৌর বিদ্যুৎ সুবিধায় তাদের ঘরে জ্বলছে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত বৈদ্যুতিক বালব। শুধু বিলের মধ্যে নয়, দুর্গম পাহাড়ে, বিচ্ছিন্ন সব চরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগের সুবিধা। গ্রিড-সুবিধা না থাকায় এসব এলাকায় কোথাও কোথাও নদী পারাপার লাইন এবং কোথাও সাগর নদীর তলদেশ দিয়ে টানা হয়েছে সাবমেরিন ক্যাবল। কোথাও আবার সেটাও করা হয়নি অবকাঠামোগত কিংবা প্রযুক্তিগত প্রতিকূলতার কারণে। তাই সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সৌর বিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম)-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এভাবেই দেশের প্রতিটি জনপদে পৌঁছানো হয়েছে বিদ্যুত সুবিধা।

বর্তমানে দেশের মোট ৪৯২টি উপজেলার মধ্যে ৪৬২টিতে বিদ্যুৎ সেবা দিচ্ছে পল্লী বিদ্যুত বোর্ড। অনেক উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের গ্রিড না থাকলেও তেমন দুর্গম প্রত্যন্ত গ্রামে তারা বিদ্যুৎ সংযোগ এর ব্যবস্থা করেছেন। হাজার হাজার পরিবার এভাবেই বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় চলে এসেছেন। বিদ্যুৎ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের কৃষি, শিল্প, সেবাখাতসহ দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকের ঊর্ধ্বগতি নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের যোগান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসার পর থেকে দুর্গম প্রত্যন্ত গ্রামের জনপদগুলো জেগে উঠেছে নতুন ভাবে। আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এসব এলাকার মানুষ।

অর্থনীতিতে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি এবং দারুণ গতি আনতে বিদ্যুৎ সুবিধা শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে সব সময়েই, সব দেশেই, সব জনপদে। আমাদের বাংলাদেশে কিছুদিন আগেও গ্রামের মানুষের একমাত্র জীবিকা ছিল কৃষি। কৃষির বাইরে অন্য কোনো পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিলনা তাদের। সেখানে বর্তমানে ছোট বড় সব ধরনের ধানকল থেকে শুরু করে গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষি জমিতে সেচের ব্যবস্হাকরণ, হাঁস মুরগির খামার, যন্ত্রচালিত যানবাহনে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা, ইউনিয়ন পরিষদে তথ্য-সেবা কেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া পাঠদানে সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় বেসরকারি উদ্যোক্তারা যুক্ত হওয়ায় এ খাতে একটি বিরাট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এখাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। কাজের মধ্যে তুলনা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে জবাবদিহিতা বেড়েছে।

গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না। সরকার এ খাতে গত বছর ২০২১ সালে ১১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নে সরকারের বিরাট সাফল্য দেশবাসীকে আনন্দিত ও আশাবাদী করেছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধার বিস্তৃতি অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের এগিয়ে চলাকে আরও বেগবান করবে। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে যেভাবে চাপ সৃষ্টি করে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে ঠিক তেমনিভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি শিল্প কলকারখানায় উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়, উৎপাদিত পণ্যের দামও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফলে বাজারেও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রকোপ দেখা যায়। যার চাপ বহন করতে হয় সাধারণ জনগণকে। সহনীয় দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারাটা বড় একটি চ্যালেঞ্জ সন্দেহ নেই। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরও দেশের সব মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে কিনা— সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

Exit mobile version