অপ্রিয় কথন : নতুন প্রজন্মের তিন সম্ভাবনাময় তরুণের অস্বাভাবিক মৃত্যু।। নুরুল হক

 

নুরুল হক

সায়েম শাহরিয়ার অন্তুঃ

সন্ধান ডেস্ক : এদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাতেগোনা যে কয়জন ছেলে-মেয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করেছে, অন্তু তাদেরই একজন। অন্তু ও তার বোন কৈশি “সূর ও ছন্দ” গানের স্কুলে যেত। আর আমার ছেলে ও মেয়ে যথাক্রমে অয়ন ও নেভিন “বিপায়” যেত। তারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো উদযাপনের সময় তারা নাচ, গান, কবিতা, তবলা, বক্তৃতা, চিত্রাংগন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করত। সংগত কারণেই অন্তুর এই অসময়ে চলে যাওয়া কম্যুনিটিকে আহত করেছে। প্রশ্নের উদ্রেক করেছে কেন সে একটি হাইওয়ের অত্যন্ত দ্রুতগতি সম্পন্ন (HOV) লেনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল যেখানে পায়ে হাঁটার কোন ফুটপাতই নেই? কি অভিমান বাসা বেঁধেছিল তার মনে? দ্বিতীয়ত, যে লোকটি তাকে গুড়িয়ে ফেলল, কেন তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয়নি? অন্তু তার বাবা-মা যথাক্রমে ইকবাল ভাই ও কুমু ভাবীর সাথে তাদের লং আইল্যান্ডের বাসায় থাকত। অন্তু কম্পিউটার সায়েন্সে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে। শুনেছি ক্যালিফোর্নিয়াতে সম্প্রতি একটি জবও পেয়েছিল!

আশরাফুল ইসলাম তৃপ্তিঃ

গত ১৩ সেপ্টেম্বর পেনসেলভেনিয়াতে বাড়ি ক্রয় করাকে কেন্দ্র করে বাবা-মা’র সাথে অভিমান করে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায় তৃপ্তি। তিনদিন পর তার বাবা-মা পুলিশে রিপোর্ট করেন! ২৬ সেপ্টেম্বর ম্যানহাটানের হাডসন রিভার থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা আশরাফুল আত্মহত্যা করেছে। নবাগত ইমিগ্র্যান্ট হয়েও তৃপ্তি কৃতিত্বের সাথে হাইস্কুল শেষ করে গত আগস্টে নিউ ইয়র্কের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’তে ভর্তি হইয়েছিল! কিন্তু কভিড-১৯ এর কারণে সে ক্লাশে যেতে পারেনি। একমাত্র সন্তান তৃপ্তি বাবা-মায়ের সাথে তাদের এল্মহার্সটের বাসায় থাকত।

উমায়ের সালেহঃ

২৩ বছরের মেধাবী যুবক উমায়ের সালেহ নিউ জার্সির নামকরা রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে। পুলিশ তার মৃতদেহ জার্সি সিটির হাডসন রিভার থেকে উদ্ধার করেছে এবং পকেটে রাখা আইডি দেখে তাকে সনাক্ত করেছে। তার মা পেশায় একজন শিক্ষিকা। তিনি পুলিশকে জানান শনিবার সকালে হাঁটার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরেনি! তাদের বাসা নিউ জার্সির এডিসনে।

কভিড-১৯ এ যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যুর মিছিলে এই তিনটি অপমৃত্যু একটু ভিন্ন মাত্রার, আমার দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মৃত্যু। এ মৃত্যু কোন ভাবেই কাম্য নয়। আমরা যারা এদেশে সন্তান লালন-পালন করছি, সময় এসেছে নতুন করে ভাববার। আর সন্তানরাই বাবা-মা’র সাথে একটু ঝগড়া বা মনোমালিন্য হলে ঘর ছাড়বে কেন? বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক হতে হবে খুবই ঘনিষ্ট ও বন্ধুর মত। শুধু শাসন অথবা রাগ করে সন্তানকে বশে আনা সম্ভব নাও হতে পারে? বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম ও বেড়ে উঠা ছেলে-মেয়েরা খুবই স্বাধীনচেতা। এটা তাদের দোষ নয়, পারিপার্শিকতাই তাদেরকে এভাবে তৈরী করেছে। ভুলে গেলে চলবেনা যে তারা একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বেডে উঠছে। আমরা যেন তাদেরকে আমাদের যৌথ পরিবারে বেডে উঠা বাংলাদেশের শৃংখলিত জীবনের ধাঁচে বেডে উঠতে বাধ্য না করি। এটা প্রাচুর্যের দেশ, এখানে অর্জন করাও সহজ আবার একটু ভুলের কারণে পথভ্রষ্ট হওয়াও কঠিন নয়! স্মরণ করে দেখুন, আমাদের শৈশবের অনেকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মেধা ও সুপ্ত বাসনাও নষ্ট হয়েছে বাবা-মা’র চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের কারনে! সেই একই কাজটি যেন আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য না করি। সন্তানের মতামত ও স্বাধীনতাকে মূল্য দিতে হবে, জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবেনা। এটা করোনা, ওটা করোনা এই লিস্ট যেন খুব বেশি লম্বা না করি। বলতে দ্বিধা নেই, অনেক বাবা-মা আছে যারা সন্তানকে সময় দেয়না, শুধু টাকার পিছনে দৌঁড়ায়। ফলে টাকা আয় হয় কিন্তু সন্তান বিগড়ে যায় অনাদরে ও অবহেলায়। অনেক বাবা-মাকে বলতে শুনেছি কালোদের সাথে মিশবেনা, স্পেনিশদের সাথে মিশবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কাদের সাথে মিশবে সেটা কিন্তু বলেনা! এটা একটি ডেলিমা। আপনি জানেন কি এই ডেলিমার কারণে আপনার সন্তানটি তার সহপাঠীদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে? বুলিং এর শিকার হচ্ছে?

আপনার সন্তানের চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণে গড়মিল লক্ষ্য করলে সংগে সংগে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। স্কুল নার্স, প্যারেন্ট কোঅর্ডিনেটর, গাইডেন্স কাউন্সিলর অথবা এসিএস (ACS – Administration for Children Services) এর শরণাপন্ন হোন। প্রয়োজনে সিটির বিভিন্ন প্রফেশনাল এজেন্সীর সাথে যোগাযোগ করে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করুন। আপনার সন্তান শুধু আপনার পরিবারের সম্পদ নয়, পুরো সমাজের সম্পদ। আসুন তাদের গড়ে তুলি স্নেহ-মমতা আর ভালবাসা দিয়ে। ভালবাসার জয় চিরস্তায়ী হয় – বল প্রয়োগ করে নয়।

সায়েম শাহরিয়ার, আশরাফুল ইসলাম ও উমায়ের সালেহ’র আত্মার চির শান্তি কামনা করি।হে আল্লাহ, তাদের পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দাও।

পুনশ্চ: উপরে প্রথম দু’টি ছবি আজ জামাইকা মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত অন্তুর জানাজা থেকে তোলা। করোনাকালে কোন জানাজায় এত লোকের সমাগম সত্যিই অবিশ্বাস্য।

লেখক মূলধারার রাজনীতিক ও কম্যুনিটি এক্টিভিস্ট। কুইন্স, নিউ ইয়র্ক।

 

Exit mobile version