সন্ধান ২৪.কম:এই যুদ্ধ নেই কোনো অস্ত্রের ঝনঝনানি। নেই বোমায় উড়িয়ে যাওয়া ভবন কিংবা ক্ষতবিক্ষত লাশের বিভৎস চিত্র। তারপরও যুদ্ধ চলছে। তবে এই যুদ্ধ অস্ত্রের নয়, অর্থনৈতিক যুদ্ধ।গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ ঘোষণা দেওয়ার পর এ পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে কাউকেই পাশে পায়নি ইউক্রেন। অস্ত্র সহায়তা পেলেও নিজেদের লড়াইটা নিজেদেরই লড়তে হচ্ছে তাদের। তবে পুতিনের সেই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর পর স্বস্তিতে নেই রাশিয়াও। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্ব একের পর চাপিয়ে দিচ্ছে নিষেধাজ্ঞা।
নিষেধাজ্ঞার বিশ্বরেকর্ড
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যমে বলা হচ্ছে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার বিশ্বরেকর্ডটি রাশিয়ার ঝুলিতেই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার পর মস্কো ২ হাজার ৭৭৮টি নতুন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। এ নিয়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৩২টিতে। মস্কোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সুইজারল্যান্ড (৫৬৮টি), ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫১৮টি, ফ্রান্স ৫১২টি কানাডা ৪৫৪টি, অস্ট্রেলিয়া ৪১৩টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র মস্কোর ওপর ২৪৩টি ও যুক্তরাজ্য ৩৫টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৪২৭টি বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর, ৩৪৩টি প্রতিষ্ঠানের ওপর, ৬টি জাহাজের ও দুটি বিমানের ওপর দেওয়া হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে সুইটফ গ্লোবাল ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে বাদ পড়েছে রাশিয়া। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে মঙ্গলবার রাশিয়ার তেল-গ্যাস ও কয়লার ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাজ্যও রাশিয়ান তেল আমদানি পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করবে। এর মধ্যে বিকল্প উপায় খোঁজার পর্যাপ্ত সময় পাবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও রাশিয়ান গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনছে।
অর্থনৈতিক লড়াই
এই নিষেধাজ্ঞাকে এরই মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক লড়াই বলে দাবি করেছে ক্রেমলিন। এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চলছে রাশিয়া-পশ্চিমা বিশ্বের পালটাপালটি বাকযুদ্ধ। তেলের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বুধবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, রাশিয়াও নিষেধাজ্ঞা দেবে। আর রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা হবে আরও ভয়ংকর।
এর আগে পুতিনও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, নিষেধাজ্ঞা থেকে আমরা লাভবানই হবো।
তবে রাশিয়ার অর্থনীতির সবশেষ পরিস্থিতি পরযবেক্ষণ করে এসব হুমকিধামকি ফাঁকা বুলি বলেই মনে হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার পর বহুজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। ফলে বেড়েছে মুদ্রাস্থীতি, অনলাইন লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে, বেড়ে গেছে কালোবাজারের ঝুঁকি। এই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে রাশিয়া হিমশিম খাচ্ছে বলে বার্তা সংস্থা এএফপি গত রোববার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল।
২৪ ফেব্রুয়ারি ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে ‘একটি বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করার পর থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুশ মুদ্রা রুবলের দাম এক চতুর্থাংশ কমে গেছে।
রুবলের এই পতন ১৯৯০ এর দশকে অর্থনৈতিক অস্থিরতার স্মৃতিতে ফের জাগিয়ে তুলছে। সে সময় মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে রাশিয়ার সাধারণ নাগরিকদের সঞ্চয়ও একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।
যদিও ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে চাঙ্গা করতে সম্প্রতি মূলধন নিয়ন্ত্রণসহ অভূতপূর্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে, রুশ অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখে দেশটির রফতানি খাত। তেলে, গ্যাস, গম, সূর্যমুখী তেলসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের অন্যতম প্রধান রফতানিকারক দেশ রাশিয়া। তবে সুটইফ গ্লোবাল ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে বাদ পড়ার কারণে রাশিয়ার এই খাতও হুমকির সম্মুখীন। দাম মেটাতে ঝামেলার কারণে ক্রেতায় এখন রাশিয়ার কাছ পণ্য আমদানি করার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারাবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রভাব পড়বে পশ্চিমা বিশ্বেও
অন্য যেকোনো যুদ্ধে যেমন দুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হয়, তেমনি অর্থনৈতিক যুদ্ধেও ক্ষতির মুখোমুখি হবে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পর বিশ্বের তৃতীয় তেল উৎপাদক দেশ হলো রাশিয়া।
দেশটিতের প্রতিদিন পাঁচ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদিত হয়, এসব তেলের অর্ধেকের রফতানি করা হয় ইউরোপীয় দেশগুলোতে।
তাই রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে আমদানিকারণদের।
এছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট গ্যাস আমদানির ৪০ শতাংশ আসে রাশিয়ার কাছ থেকে।
যদি এই সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, বিশেষ করে ইতালি এবং জার্মানি সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়বে। এই অবস্থায় কাতার, আলজেরিয়া এবং নাইজেরিয়ার মতো বাকি আদমানিকারক দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে পারে ইউরোপ। তবে সেক্ষেত্রে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির বাস্তব সমস্যার বিষয়টি সামনে আসবে।
তাছাড়া তেল আর গ্যাসের দাম বাড়লে অবধারিতভাবেই বাড়বে বিদ্যুতের দাম। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানির বড় উৎসই তেল ও গ্যাস। তাই তেল-গ্যাসের দাম বাড়ার প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ খাতে। বেড়ে যাবে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ। শীতের মৌসুমে ইউরোপের বেশির ভাগ মানুষ বাড়িঘর উষ্ণ রাখতে বিদ্যুতের সাহায্য নেয়। তাই বিদ্যুত খরচ বৃদ্ধির প্রভাবও এড়ানো সম্ভব নয়।