সনজীবন কুমারঃ আজ ২০ জানুয়ারি। আমেরিকার ইতিহাসে ঘটতে যাচ্ছে এক অনন্য ঘটনা।
হরষে-বিষাদে মেশানো যে ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে থাকবে পুরো বিশ্বের মানুষ।
আনন্দ-উচ্ছ্বাস এই জন্য যে, আজকের এই স্বর্ণময় দিনটির মধ্যদিয়ে বিশ্ববাসী আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
পাশাপাশি বিষাদ এই জন্য যে, ২০ জানুয়ারী,২০২১ খৃীষ্টাব্দ ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেব চিহ্নীত হয়ে থাকবে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তিনি জো বাইডেনের আজকের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না।
পাশাপাশি দিনটি জাতিকে দ্বিধাবিভক্তের দিন হিসেবেও মনে রাখবে।
প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে ২০ জানুয়ারি দুপুর ১২টায় বিদায়ী দেশনেতাকে পাশে নিয়ে আমেরিকায় শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। অভিষিক্ত হন নতুন প্রেসিডেন্ট। এমনকি, যে প্রার্থী সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে ভোটে হেরেছেন, তিনিও প্রচলিত রীতি মেনে পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে এই দিনটিকে পালন করেন। এই জন্য যে, নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সার্বভৌমত্বকে বৈধতা দেওয়া। কিন্ত এবারের অভিষেক অনুষ্ঠানের সুর ফিকে আর ধূসর হয়ে বাজবে। কারণ,মহাযজ্ঞে থাকছেন না ডোনাল্ট ট্রাম্প। অর্থাৎ এক অর্থে বাইডেনের জয়কেই বৈধতা দিতে চাইছেন না ট্রাম্প।
তবে ছন্দপতন শুধু এবারই হচ্ছে না, এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। ১৮৬৯-এর সেই বিষন্ন সেই কালের চাকা আবার ঘুরে এল দীর্ঘ ১৫১ বছর পর।
যেমন এর আগে শেষবার ৪ মার্চ, ১৮৬৯। ওয়াশিংটন ডিসি-র সকাল পেরিয়ে দুপুর আসার সঙ্গে সুরও কেটেছে। বিদায়ী অ্যান্ড্রু জ্যাকসন। তিনি ঘোষনা দিলেন আগামী প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস গ্র্যান্টের শপগ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকছেন না।
প্রথা অনুসারে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর স্ত্রী উদ্বোধনের দিন সকালে হোয়াইট হাউসে নবাগত এবং তার স্ত্রীকে স্বাগত জানান। কিছু পরে সস্ত্রীক বিদায়ী ও নতুন প্রেসিডেন্ট একই গাড়িতে চড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্যে ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের উদ্দেশে রওনা হন। পরবর্তীকালে নব্য প্রেসিডেন্ট শপথগ্রহণের দিন অবশ্য ৪ মার্চ থেকে ২০ জানুয়ারিতে বদলে যায়।
আমেরিকার গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা হওয়ার আগে এমন ঘটনা ঘটেছে আরও দুবার। ১৮০১ সালে এই ঘটনা ঘটান জন অ্যাডামস। এর পর আবার সেই পথেই হাঁটেন তাঁর ছেলে জন কুইন্সি অ্যাডামস, ১৮২৯ সালে। আর এ বারে বহুল আলোচিত-সমালোচিত ট্রাম্পকে ধরলে মোট চার। আগের এই সমস্ত ঘটনা কিন্তু আমেরিকার গণতন্ত্রের একেবারে প্রথমএকশো বছরের। আর আজকেরটা দেড়শো বছর পার করে, আমেরিকা যখন সাবালক হয়ে, সারা বিশ্বকে গণতন্ত্র শেখাতে মাষ্টারের ভূমিকায় বসে আছেন ।
প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আমেরিকানদের কাছে কেবলমাত্র কোন ‘আনুষ্ঠানিকতার দিন’ নয়। এ দিনটি হলো ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় রাজনৈতিক, সামাজিক,অর্থনৈতিক,ধর্ম-বৈষম্যে সবকিছুকে দূরে সরিয়ে রেখে দেশ-জাতিকে একসুতোয় বাঁধার পবিত্র কাজ।
আজকের এই দিনটি আমেরিকার সমস্ত মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। কিন্ত বুধবারটির উদ্বোধনটি কেমন যেন একটু অন্যরকম হয়ে গেল।
গত নভেম্বরে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়েছে ট্রাম্পবাদী মিথ্যাচার ও হুমকি। আর দেশের প্রেসিডেন্ট উস্কানি দিলেন তাঁর সমর্থকদের, আর সেই দাঙ্গাবাজেরা আক্রমণ করে বসল আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটল বিল্ডিং-এ। দেশের মানুষ কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এই অবস্থায় প্রেক্ষিতেই ভীষণ জরুরি ছিল গণতন্ত্রের উৎসবে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের উপস্থিত থাকা। বিশেষত, গত দু সপ্তাহের ঘটনাবলীর পর সত্যিই দেখানোর দরকার ছিল যে সমস্ত তিক্ততার পরও দেশ ও জাতির স্বার্থে বিদায়ী এবং নব্য প্রেসডেন্ট এক মঞ্চে দাঁড়াতে পারেন।
এখনও শোনা যাচ্ছে ২০ জানুয়ারি বিভিন্ন রাজ্যে সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে পারেন সশস্ত্র ট্রাম্পপন্থীরা। বেশ কয়েটি রাজ্যে ‘রেড এর্লাড’ জারি করা হয়েছে। ক্যাপিটাল হিল ‘রাজনৈতিক লকডাউন’ ঘোষনা করা হয়েছে। তাই সব কিছুমিলে আপাতত গোটা আমেরিকা খুব সাবধানে পা ফেলছে। দীর্ঘকালের বেশ কয়েকটি প্রথা এবার আর পালিত হচ্ছে না। ট্রাম্প সমর্থকদের সাথে তিক্ত দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ এড়াতে হচ্ছে না ক্যাপিটল মলে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে আনন্দঘন অনুষ্ঠান উদযাপন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ওয়াশিংটন ডিসির আশেপাশের ঘরবাড়ি কয়েকদিনের জন্যে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েকটি বিমান পরিচালক সংস্থা বুধবার পর্যন্ত চেক-ইন লাগেজে সমস্ত হ্যান্ডগান নিষিদ্ধ করেছে।
বিদায়ের আগে ওবামার লেখা চিঠির খামে ট্রাম্পকে সম্বোধন করা হয়েছিল ‘প্রেসিডেন্ট’ বলে। সেই চিঠির কথা ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে রেখেছেন কি না জানা নেই। হয়ত মনে থাকলেও সেই চিকন-চাকন কালো মানুষটাকে অনুসরণ করে তিনি বাইডেনকে ‘প্রেসিডেন্ট’ বলে সম্বোধন করবেন কি ? তা আজই জানা যাবে।
২০ জানুয়ারি কিছুটা অন্যরকম হলেও বাইডেন তার বক্তৃতায় আমেরিকা এবং বিশ্বের মানুষকে যদি নোতুন স্বপ্নে জেগে তুলতে পারেন,তবে আজকের দিনটা কালো হলেও,তার উদ্ভাসিত কথায় সমস্ত গ্লানী মুছে যাবে। আমরা জেগে থাকলাম সেই স্বপ্নঘোরের উৎসভূমে।


