মুঈদ রহমান : গেল সপ্তাহজুড়ে আলোচিত বিষয় ছিল রপ্তানি। গত অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয় রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আমরা যে কোনো বিষয়কে তুলে ধরার সময় চূড়ান্ত অবস্থানে থাকতে পছন্দ করি। অর্থাৎ, কোনো একটি বিষয়কে হয় অতিমূল্যায়ন করি, নতুবা অবমূল্যায়ন করি; কিন্তু প্রকৃত মূল্যায়ন করতে অপারগ, অনিচ্ছুক। রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের অন্ধ-সমর্থন কিংবা অন্ধ-বিরোধিতার আশ্রয় নিই বলে অনুমান করি। এ ধরনের সংস্কৃতি প্রকৃত ভবিষ্যতের গতি নির্ধারণ করতে অক্ষম। তাই আমাদের এ ধরনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যথার্থ মূল্যায়নে মনোযোগী ও আগ্রহী হয়ে উঠতে হবে।
গত অর্থবছরের সমাপ্তি ঘটল ১৭ দিন আগে, অর্থাৎ ৩০ জুন। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালে জুন পর্যন্ত আমাদের রপ্তানি আয় নতুন মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলো মন্তব্য করেছে। প্রথমবারের মতো মোট রপ্তানি আয় ৫২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। গত অর্থবছরের রপ্তানির এ আকার আমাদের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয় ছিল ৩৮ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। একে ভিত্তি ধরে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আমাদের আয়ের আকার দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, যা কিনা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি এবং এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। রপ্তানি আয়ের এ প্রবৃদ্ধিতে তৈরি পোশাক খাত বরাবরের মতোই এগিয়ে আছে। গেল অর্থবছরের মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে এ খাত আয় করেছে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। এবারে এ খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশ এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প, প্লাস্টিক, মৎস্য ও হিমায়িত খাদ্য থেকে। এ খাতগুলোয়ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে।
করোনা-পরবর্তীকালে রপ্তানি খাতের এ অর্জন আমাদের সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। তবে সতর্ক থাকতে হবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রাস্ফীতি রপ্তানিকারক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদায় সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ের ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি তো আছেই। এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যে ক্রমাগত সংকট তৈরি করে যাচ্ছে। তাই যে কোনো দেশে, বিশেষ করে যেসব দেশে আমাদের পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সেসব দেশে যে কোনো ধরনের চাহিদার কমতি হলে এর বিরূপ প্রভাব আমাদের রপ্তানি খাতে পড়তে পারে। তাই রপ্তানি প্রক্রিয়াকে যথাযথ মাত্রায় রাখতে আমাদের কিছু করণীয় আছে। অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদের মত হলো, ‘রপ্তানি আয়ের নতুন মাইলফলকে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে নতুন পণ্য উদ্ভাবন, পণ্যের নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান, সঠিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ জরুরি। একই সঙ্গে কারখানার পরিবেশ উন্নয়ন, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দক্ষ শ্রমিকদের উৎসাহ ও আয়বৃদ্ধি নিয়ে ভাবতে হবে। আর বড় বাজারগুলোয় আরও বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে সাফল্য বৃদ্ধি, সামগ্রিক বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, এমনকি রপ্তানি শিল্প-মালিক ও কর্মকর্তাদের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে জোর দিতে হবে। এসবের ওপরই নির্ভর করবে আমাদের রপ্তানির ভবিষ্যৎ।’ তবে সমালোচকদের ভাষ্য হলো-এই যে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি, এর মূলে যে শ্রমিক রয়েছে, তাদের আয়ের কোনো প্রবৃদ্ধি ঘটবে না; উন্নত হবে না জীবনমানের; আয়বৈষম্য হ্রাস পাবে না; পুঁজি কেন্দ্রীভূত হবে মাত্র।
আগেই বলেছি, রপ্তানি আয়বৃদ্ধির এ চিত্র আশাজাগানিয়া। কিন্তু কিছু গণমাধ্যম ও ব্যক্তি যতখানি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আত্মহারা হচ্ছে, প্রকৃত চিত্র মোটেই তেমন নয়। একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। রপ্তানি আয় বাড়তে পারে দুটি কারণে-এক. রপ্তানির মোট পরিমাণ বৃদ্ধি; দুই. রপ্তানি পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধি। যদি শুধু রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ত, তাহলে সন্তুষ্টির পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। কিন্তু পরিমাণের সঙ্গে আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির বড় একটি কারণ হলো-পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। মনে রাখতে হবে-আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি যেমন আমার পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে, তেমনই আমাদের পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত আমদানীকৃত কাঁচামালের দামও বৃদ্ধি করে। ফলে বেশি আয়ের সঙ্গে সমান তাল দিয়ে বেশি খরচটাও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। তা না হলে প্রকৃত লাভক্ষতির হিসাব কষা যাবে না।
আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হলো তৈরি পোশাক খাত। এ খাতে ব্যবহৃত কাঁচামাল যেমন কাপড়, সুতা, সুঁই-এসব মূলত আমদানি করতে হয়। ১০০ ডলার রপ্তানি করলে ৭৫ ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তাই আমাদের আমদানি খরচও বেড়েছে। গত বছর আমাদের আমদানিতে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। আমাদের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সেখানে আমরা রপ্তানি করেছি ৫২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৮ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত আয় করেছি; বিপরীতে রপ্তানিতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছি ৯ বিলিয়ন ডলার। হিসাব করলে দেখা যাবে, ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়েছে’। তবে হ্যাঁ, তারপরও অতিরিক্ত রপ্তানি আয় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বাড়তি চাপ কমাতে সাহায্য করবে, যদিও শুধু এতেই আমরা রিজার্ভের চাপমুক্ত নই।
আমরা চাপমুক্ত নই এ কারণে যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সরকারের কথাতেই আমরা ধরে নিতে পারি যে, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪০ থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলার। আমাদের প্রতিমাসে আমদানি ব্যয় মেটাতে হয় ৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ৬ মাসের আমদানি ব্যয় হাতে আছে। এ বছর আমরা আমদানিতে ব্যয় করেছি প্রায় ৮৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রপ্তানি করে আয় করেছি প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে যোগ হবে প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। এর মানে হলো, ৮৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যয়ের বিপরীতে আয় ৭২ বিলিয়ন ডলার। এ অতিরিক্ত ১২ বিলিয়ন ডলারের চাপ তো রয়েই গেল! এর সঙ্গে রয়েছে আমাদের রিজার্ভ নিয়ে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ এ হিসাবে আপত্তি জানিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নির্দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের ‘রিফাইন্যান্সিং স্কিমের’ আওতায় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। রিজার্ভের হিসাবে এ সাড়ে ৭ বিলিয়নও ধরা হয়েছে, যা যথাযথ নয়। ঋণ কখনো রিজার্ভ হয় না। তাই যদি হয়, তাহলে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অনেকেই মনে করেন, এ সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়া গেলেও তা বৈদেশিক মুদ্রার অবয়বে আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হবে না। এর বাইরে রয়েছে প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহে কমতি। গত বছরের তুলনায় এ বছর রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। খোলাবাজার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের দামের মধ্যে পার্থক্য ১০ টাকারও বেশি। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাঠাতে প্রবাসীদের অনাগ্রহ বেড়েছে।
সব মিলে বলা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ খুব অল্প সময়ে মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করা হলেও তাদের কর্মতৎপরতা উদ্বেগের আভাস দেয়। বর্তমান সময়ে বাজেট সহায়তা হিসাবে সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে ১ বিলিয়ন ডলার বিনা সুদে ঋণ চেয়েছে। আগামী তিন বছরে কিস্তিতে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের স্বল্প সুদে ঋণ চাওয়া হয়েছে আইএমএফ-এর কাছে। তবে এ ঋণ কী শর্তে, কোথায় ব্যবহার করা হবে, তার কোনো স্বচ্ছ চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দার্শনিকের মতো ধার করে বলা যায়, তরতর করে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে কৃতিত্ব আছে বৈকি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কৃতিত্ব হলো, প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করার সক্ষমতা তৈরি করা। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, সফলতার উচ্ছ্বাস যেন ব্যর্থতার বানে ভেসে না যায়।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়