ইমাম কাজী কায়্যূম : প্রথমত ইসলাম হলো শান্তি, সৌহার্দ্য ও বিবেক সম্মত একটি মানবিক ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থার নাম। শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম নিয়ে ও নিজের স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহার করে এমন কোনো কাজ কোন মুসলমানের করা ঠিক নয় এবং অনুচিত যে, তাতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অশান্তি ও অসুন্দরের সৃষ্টি হয়। যার দরুণ উপস্থিত সময়ে কিছু না হলে বা ঘটলেও পরবর্তিতে তা পুরো মুসলিম কম্যিউনিটির জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।মনে রাখা আবশ্যক যে, যেকোন ধর্মের প্রতিটি ধর্মীয় বিষয় আবেগ পূর্ণ হয়ে থাকে। যদিও দেশের প্রচলিত আইনে সে আবেগের চর্চা কিংবা তাতে বাঁধা প্রদান করা অথবা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সব সময় সম্ভব হয়ে উঠেনা। বিবেক সম্মত বলতে আমরা তাই বুঝি যে, আবেগের বশীভূত হয়ে বা অনুসারীদের আবেগের সুযোগ নিয়ে কিংবা ভক্তদের অনুপ্রাণিত করে ধর্মের নামে এমন কোনো অসুন্দর কাজ করা, অর্থাৎ এক ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কিনে তাতে আরেকটি ধর্মের ( হোকনা ইসলামই ) ধর্মীয় চর্চার অনুশীলন করা বিবেক সম্মত কাজ হতে পারেনা।
কেননা, আমাদের নবীজী বা সাহাবায়ে কেরাম, কিংবা কোনো ইমাম বিগত সময়ে কোনদিনই এমন কাজ করেননি। বলা বাহুল্য যে, ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় যে, হজরত ওমরের (রা) শাসন কালে ইরাকের গভর্ণর গরীর খৃষ্টানদের কাছ থেকে একটি গীর্জা কিনে নিয়ে তা মসজিদে রূপান্তরিত করার খবর হজরত ওমরের কাছে আসলে তিনি রাগে রাগান্বিত হয়ে গিয়ে সেখানে নিযুক্ত মুসলিম গভর্ণরকে গীর্জাটি খৃষ্টানদের কাছে তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিতেই শুধু আদেশই করেন নি, বরং বাইতুল মালের অর্থ ব্যয় করে তা আরোও সুন্দর ও প্রশস্ত করে বানিয়ে দিতে নির্দেশ প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, বাইতুল মাকদিসকে (মুকাদ্দাস) যখন হজরত ওমর জয় করেন এবং এর চাবি ও মানিকানা তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, তখন ছিল আসরের নামাজের সময়। হজরত ওমর নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুত হলে তাঁকে বলা হলো, আমীরুল মুমিনীন, বাইতুল মাকদিস আমাদের হাতে চলে এসেছে, আসুন একেবারে ভিতরে গিয়ে ঠিক ঐ জায়গায় আমরা নামাজ পড়ি, যেখানে ইহুদীরা তাদের প্রার্থনা করে। হজরত ওমর আবেগী সতীর্থদের এমন প্রস্তাবে রাজী হোননি। তিনি বললেন, আইনগত ভাবে আমরা তা করলে আজ কেউ আমাদেরকে বাঁধা দিতে পারবে না। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে বারংবার এই বলে বাঁধা দিচ্ছে যে, ওমর এমনটি করবেনা। বরং এরই পাশে অন্য কোন স্থানে মসজিদ নির্মাণ করে সেখানেই নামাজ পড়ে নাও। কেননা, এমনটি করলে আমাদের অমুসলিম ভাইয়েরা ইসলামের প্রতি অসুন্দর ধারনা পোষণ করবেন বলে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে। …ইতিহাস সাক্ষী, হজরত ওমর বাইতুল মালের পয়সা খরছ করে পাশেই আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করে সেখানেই নামাজ আদায় করতে লাগলেন, আন্তধর্মীয় স্বাক্ষর হিসেবে সে মসজিদটি এখনোও সেখানে বিদ্যমান আছে। এবার যদি আমাদের আবেগী ভাইদের প্রশ্ন করি, মসজিদ বানানোর নমুনা আপনারা কি হজরত ওমরের চেয়ে বেশি ভালো বুঝেন?
আমেরিকা, লন্ডন ও কানাডার মত অমুসলিম দেশের রিয়েল এস্টেট আইনে ও ব্যবসায় কোনো পরিত্যক্ত চার্চ, মন্দির, সিনেগাগ কিংবা টেম্পল কিনে নেয়া বৈধ এবং আইনের কারনে কেই কিছু না বললেও, ভিতরে ভিতরে মুসলিমদের প্রতি ঐ এলাকা বা নেইবারহুডের অমুসলিমদের যে অদৃশ্য বিদ্বেষী মনোভাবের দানা মেলে ওঠবে হজরত ওমরের মত মানসিকতা নিয়ে কি একটি বারও কি আমাদের তথাকথিত ইমামরা, যারা এমন কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা কি চিন্তা করে বিষয়টি দেখেছেন?
তবে, হেঁ অমুসলিম প্রবাসের মুসলিম জনগোষ্ঠির ধর্মীয় প্রয়োজনে যদি মসজিদ নির্মাণ করতেই হয়, তাহলে গীর্জা কিনে কেন? খালি জায়গা বা কমার্শিয়াল প্রপার্টির কি অভাব আছে যে, মুসলিম কম্যিউনির প্রয়োজনে তা কিনতে চাইলে কিনা সম্ভব হবেনা? ইসলামকে এতই দেউলিয়া মনে করা ঠিক নয় যে, সুযোগ পেলেই বা পেয়েই মুসলমানদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে অমুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিনে তা মসজিদে রূপান্তিত করতেই হবে…? কেন?
যদিও সচরাচর এমনটি হয়না, তবুও বিষয়টি যদি আমরা বিররীত ভাবি, তাহলে আমরা মুসলমানদের কাছে তা কেমন মনে হবে?
ভুলে গেলে চলবেনা যে, ভারতের বাবরী মসজিদকে মন্দির বানানো নিয়ে আমরা কতইনা চিল্লাপাল্লা করেছি। কিছুই করতে পেরেছি? না। আর পারবোও না।
বলা বহুল্য যে, এতে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতিও বিনষ্ট হয়। তাই, ধর্মীয় ব্যাপারের আবেগ সবারই আছে। হিকমতের সাথে সে আবেগকে কাজে লাগানো বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করি।
-ইমাম কাজী কায়্যূম, মোহাম্মদী সেন্টার, নিউইয়র্ক।