মহসীন হাবিব : কোনো প্রতিবেশী যখন শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করতে থাকে তখন বিদ্বেষ পোষণ না করে বরং খুশি হওয়া এবং সমর্থন জোগানোই সমীচীন, মহত্বের লক্ষণ ও বুদ্ধিমানের কাজ। ছোট গাছের পাশে যদি বড় বৃক্ষ থাকে তবে ছোট গাছটি ঝড়-বাদল থেকে খানিকটা প্রোটেকশন পেতে পারে। কিন্তু প্রতিবেশী যদি হয় অসৎ, আগ্রাসী ও ধুরন্ধর তাহলে সেই প্রতিবেশীর বড় হওয়াটা বিপজ্জনক এবং হুমকিস্বরূপ। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশীর ব্যাপারে সজাগ, সতর্ক এবং সন্দেহপ্রবণ থাকাই কর্তব্য। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থাতেও একথা শতভাগ সত্যি। বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেশী হিসাবে চীনের বিষয়টিও ঠিক তেমন হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশ চীন। চীন এখন বিশ্বের একটি সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু সব দিক গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ ‘ক্যানারি ইন দ্য কোল মাইন’-এ পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র চীনের বিনিয়োগক্ষেত্রই হয় নাই, ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম টার্গেটে পরিণত হতে চলেছে।
বাংলাদেশে এখন বহু মানুষকে দেখা যাচ্ছে চীনের এগিয়ে আসা দেখে আগে পিছে চিন্তা না করে তাধেই তাধেই করছেন। কিন্তু এই অতি উৎসাহের আদৌ কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? উদাহরণস্বরূপ একটি গল্প বলি।
বশিরের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সুদখোর জালাল মিয়া, ‘কী বশির চলতেছে কেমন?’
‘ আপনাদের দোয়া, চলে যাচ্ছে বড়ভাই।’
‘দোয়া তো অবশ্যই করি। কিন্তু তোমার চলতেছে কোথায়, ঘরটা নড়বড়ে, পায়খানাটা ভাঙাচোরা, কলতলা পাকা হয় নাই।’
‘জি, তা অয় নাই জালাল ভাই।’
‘তাইলে কইরা ফালাও, দেরি করতেছো ক্যান?’
‘করবো ভাই, হাতে একটু টানাটানি আছে। এখনই পারতেছি না।’
‘আহা না পারার কী আছে! চিন্তা করো ক্যান? টাকা লাগলে নেও, আমি তো আছি! ভালো কথা, তুমার বৌটা কই, তারে দেখতেছি না যে? তারে পাঠায় দিও, সে টাকা নিয়া আসবে। চিন্তা কইরো না। তুমি মাসে মাসে সামান্য কিছু কিছু ফেরত দিও।’
এই অবস্থায় নগদ অর্থ পাওয়ার খুশিতে বশির যদি দিবাস্বপ্ন দেখে ফেলে তাহলেই কেল্লা ফতে! নীরবে বশিরের ঘাড়ে চেপে বসবে জালালের টাকার সুদ, ছা-পোষা বশির কয়েক মাস পরেই দেখবে আগে টেনেটুনে সংসার চলছিল, কিন্তু ঘর-দুয়ার ঠিক করতে গিয়ে, কলতলা পাকা করতে গিয়ে এখন মাসে মাসে জালালের সুদের টাকা গুনতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘরের খাবারও নেই। সেইসঙ্গে বশিরের স্ত্রী টাকা আনতে গেলে তাকে আর সাবিত্রী বলা যাবে না, এতে কোনো সন্দেহ নাই। বাংলাদেশ আর চীনের সম্পর্ক বশির আর জালালের মতো।
চীনের এই থাবা প্রসারিত হচ্ছে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে এমনকি ইউরোপেও। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ এবং দুর্বল দেশ হিসাবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের মতো দেশগুলির উপর তীব্র শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে। এই দেশগুলিতে শুধু ব্যবসাই নয়, ভৌগোলিক মানচিত্রের দিকেও চীনের আগ্রাসী থাবা এগিয়ে আসছে। সম্প্রতি নেপাল সরকারের একটি গোপন রিপোর্ট ফাঁস হয়েছে। সেই রিপোর্টে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে, চীন নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের হুমলা জেলায় ঢুকে পড়ছে। একই আচরণ ভারতের সঙ্গে করতে গিয়ে তারা একাধিকবার ভারতের সঙ্গে সংঘাত ডেকে এনেছে। চীন তার সম্প্রসারণের একটি পথ হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলোকে টার্গেট করেছে। যেমন পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, বাংলাদেশের চিটাগং বন্দর এবং মিয়ানমারের কিয়াকপিউ বন্দর।
চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন খালি চোখে দেখেও অনেকে সেটা ঠাওর করতে পারছেন না। চীনের বিনিয়োগের মাত্রা এবং ঋণের ওপর ৬-৮ শতাংশ সুদের হারের কারণে (যেখানে কি না বিশ্ব ব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ০.২৫-৩ শতাংশ সুদ হারে ঋণ প্রদান করে থাকে) এই দেশগুলোর ঋণের পাল্লা এখন অনেক ভারী হয়ে গেছে। হাম্বানটোটার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় এবং চীনের ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি’-এর শিকার হয়। অগত্যা তাদেরকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে ইজারা দিয়ে হস্তান্তর করতে হয়। বন্দরগুলো নিয়ে চীনের পরিকল্পনাকে ঘিরে অনেকেই এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, চীন যদি এই বেসামরিক বন্দরগুলোকে সামরিক নৌ-ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে, তবে এই অঞ্চলে নৌ-ঘাঁটির অভাবের কারণে চীনের যে কৌশলগত দুর্বলতা রয়েছে, সেটা সে কাটিয়ে উঠতে পারবে।
চীনের আরেক প্রতিবেশী হংকং, যে দেশটি আছে সবচেয়ে কঠিন এক পরীক্ষায়। প্রতিবেশী হিসাবে চীনের রাজনৈতিক আগ্রাসন কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জ¦লন্ত উদাহরণ হংকং। ১৯৯৭ সালে হস্তান্তরের পর থেকে হংকং-চীন সম্পর্ক আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। চীন এবং যুক্তরাজ্য উভয়ের স্বাক্ষরিত চীন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণা আংশিকভাবে কমিউনিস্ট শাসন থেকে আলাদা করে হংকংকে চীনের কাছ থেকে একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেয়। সেই ঘোষণায় হংকংয়ের বেসিক ল’ (মৌলিক আইন) অর্থাৎ তাদের ক্ষুদ্র-সংবিধান হিসেবে পরিচিত নিজস্ব সংস্করণে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’কে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং যেটি তখন থেকেই বিতর্কের কারণ হয়ে আসছে।
‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ এই নীতি হংকংয়ের জনগণের প্রতিবাদ-সমাবেশ, বিক্ষোভ-সভা করার অধিকারকে এবং বাক-স্বাধীনতার অধিকারকে রক্ষা করে; যে অধিকারগুলো খোদ চীনেই অপব্যবহৃত এবং উপেক্ষিত হয়ে থাকে। দেশটির মৌলিক আইনে ‘সর্বজনীন ভোটাধিকার’ হংকংয়ের জনগণের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বিবৃত হয়েছে। অথচ, বর্তমানে সেখানে শুধুমাত্র ১২০০ জনের স্বল্পসংখ্যক একটি গোষ্ঠীকে সমাজের অভিজাত বলে বিবেচনা করা হয় এবং কেবল তারাই শহরের সর্বোচ্চ নেতৃত্বদানকারী, অর্থাৎ প্রধান নির্বাহী, যারা নির্বাচন করার যোগ্যতা রাখেন। এতে হংকংয়ের জনগণ বুঝতে পারে, তাদের যে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তা কখনো সত্য হয়নি এবং সম্ভবত এটি কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। ফলে, পরবর্তী দশকগুলিতে ধারাবাহিক সংঘর্ষ এবং চীনবিরোধী বিক্ষোভের অবসানও ঘটবে না।
চীনা সংবিধান অনুযায়ী, হংকং এর জনগণকে সমাবেশ-বিক্ষোভ এবং বাক-স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, সেই অধিকারগুলি সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। হংকং হস্তান্তরের পর ৫০ বছরের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা ছিল। সেই সময় প্রায় পার হওয়ার পথে। কিন্তু চীন সাবেক এই ব্রিটিশ উপনিবেশকে তাদের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সমস্ত দিক দিয়ে নিজদের করে নেওয়ার জন্যে ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক ও কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ নিয়েছে।
চীনের আরেক বৈষম্যপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, ইংরেজিতে যাকে বলে টিবেট। ঐতিহ্যগতভাবে তিব্বতে বসবাস করে আসছিল মোঙপা, তামাঙ, কিয়াঙ, শেরপা এইসব জনগোষ্ঠী। তাদের অধিকাংশই ছিল যাযাবর। কিন্তু চীন তিব্বতকে চীনা জাতিতে রূপান্তরিত করতে বদ্ধপরিকর। এখন তিব্বতের বিশাল অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে ঢুকে পড়ছে হান চাইনিজ ও হুই চাইনিজরা। ঐতিহ্যগতভাবে যাযাবর অধিকাংশ তিব্বতীয়দের গুচ্ছ আকারে বসবাসে বাধ্য করা হচ্ছে। আর তারই অংশ হিসেবে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় তারা তিব্বতের ইতিহাস ও পরিচয় মুছে দিতে তৎপর। বিশেষ করে যেখানে তিব্বত ও ভারতের মধ্যে গভীর এক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। তিব্বতের ল্যান্ডস্কেপকে চীনা ল্যান্ডস্কেপে পরিণত করার অর্থ হলো, সেখানে বিরাজমান পশুপালক এবং তাদের পশুপালনকে অব্যাহতভাবে অপসারণ করা।
ভাটির দেশের মানুষের জন্য চীনের বিস্তৃত পরস্পরবিরোধী উচ্চাকাঙ্ক্ষা খুবই বিভ্রান্তিকর। চীন ধারাবাহিকভাবে তিব্বতিদেরকে একটি পশ্চাৎপদ উপজাতি হিসেবে দেখে আসছে এবং তারা মনে করে, তিব্বতিদের ‘সভ্যতার’ প্রয়োজন। তাদের জমির মেয়াদের দলিলপত্র বাতিল করা হয়। শহরের কাছাকাছি কোথাও বসতি গড়তে বলা হয় এবং নগরে গিয়ে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজে যোগদান করতে তাদের সমস্ত পশুসম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়।
পাকিস্তানকে প্রতিবেশী না বলে এখন আজ্ঞাবহ দেশ বলাটাই সমীচীন। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার অন্যতম কারণ দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘন। আর এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান বিষয় হলো চীনের মুসলমান অধ্যুষিত উঈঘুর অঞ্চলে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি দমন-পীড়ন। অথচ ইসলাম ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য স্পর্শকাতর দেশ পাকিস্তান সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ চুপ। বরং মানবাধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে কূটনীতিক পাঠানো পরিত্যাগ করেছে, তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চারদিনের এক উষ্ণ সফরে মত্ত হয়েছেন। মূলত চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের এই বড় অন্তরঙ্গতার প্রধান কারণ হলো ভারতবিরোধী অবস্থান। সেইসঙ্গে চীনের ২৫ বিলিয়ন ডলারের চায়না পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর পাকিস্তানকে চীনের দাসে পরিণত করেছে। বরাবরই পাকিস্তান সৌদি আরবের সহায়তা ও সহানুভূতি পেয়ে আসছিল। কিন্তু সালমান যুবরাজ হিসাবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর হিসাব-নিকাশ পালটে গেছে। ২০২১ সালের সৌদি আরব পাকিস্তানকে দেওয়া ৩ বিলিয়ন ডলার ফেরত দিতে চাপ প্রয়োগ করে। পাকিস্তান প্রথম জুলাই মাসে ১ বিলিয়ন ডলার ফেরত দেয় এবং ডিসেম্বরে আবার সৌদি আরব চাপ দিলে চীনের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে সৌদি আরবকে ফেরত দিতে হয়। পাকিস্তান ও চীনের এই সখ্যে অন্য প্রতিবেশীদের আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কিন্তু এই দুটি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিবিড় সখ্য এই অঞ্চলের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। চীন যেমন তার আগ্রাসী বাণিজ্য এবং সম্প্রসারণবাদের দিকে মনযোগী একইভাবে পাকিস্তানও চীনের ছত্রছায়ায় গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ সম্প্রসারণে মরিয়া। সুতরাং প্রতিবেশী দেশগুলি এখনই সতর্ক না হলে বড় দেরি হয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
