ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ নিয়ে চীনের অবস্থান বেশ বিতর্কিত। রাশিয়া বিরোধীরা প্রথম থেকেই চীনের অবস্থানকে সন্দেহজনক হিসেবে দেখছে। একদিকে চীন অস্বীকার করেনি যে, এই যুদ্ধটি ‘স্বার্বভৌমত্ব’ এবং ‘আঞ্চলিক অখণ্ডতার’ মতো ইস্যুগুলোর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। অপরদিকে দেশটি সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণকেই এই যুদ্ধের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগকে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন।
চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় এই যুদ্ধ নিয়ে মতামত প্রদানকারীদের বেশিরভাগই রাশিয়ার পদক্ষেপের বিষয়ে তাদের গভীর উপলব্ধির কথা জানিয়েছেন। এটিকে সরাসরি যুদ্ধের প্রতি সমর্থন বলা যায় না। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর রাশিয়া ও চীনকে টার্গেট করে আক্রমণ চালানোর ফলে দুই দেশের মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ আবেগের জন্ম হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইউক্রেনের স্বার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার ওপরে জোর দিচ্ছে, তখন বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের দ্বিমুখী আচরণের কথা তারা ভুলে যাচ্ছে।
স্নায়ু যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পশ্চিমারা ‘ওয়েস্টফালিয়ান নীতি’ বর্জন করেছে। তারা বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিকীকরণ এবং পরস্পর নির্ভরশীলতার নামে জাতিসংঘের কতৃত্বকে দুর্বল করেছে। মানবাধিকার রক্ষার তথাকথিত দায়িত্বের নামে পশ্চিমা দেশগুলো ‘সশস্ত্র মানবিক হস্তক্ষেপ’কে বৈধতা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার ও নেতাদের উৎখাত করেছে। জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়া ১৯৯৯ সালে কসোভোতে ন্যাটোর হস্তক্ষেপ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক হামলাও ছিল অবৈধ।
ইউক্রেনে যে যুদ্ধ চলছে তার দুইটি ফলাফল হতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এটি হবে চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চীন যদি রাশিয়াকে সমর্থন দিতে শুরু করে তাহলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। যদিও চীন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, ইউক্রেনের যুদ্ধ ছাড়াই চীনকে যুক্তরাষ্ট্র নাম্বার ওয়ান ‘পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দী’ হিসেবে বিবেচনা করে। নিশ্চিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই থাকবে। যুক্তিটা খুব সহজ: পশ্চিমা মিত্রদেশগুলো নিজেদের বাইরের কারো আধিপত্য মেনে নিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভূ-রাজনীতি, নিরাপত্তা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি এবং আদর্শগত দিক থেকে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার সংকট সমাধানে ইইউ খুব বেশি কার্যকরি কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে কাজ করেছে, ভবিষ্যতেও তারা এভাবেই থেকে যাবে। ইইউ’র দুর্বলতার কারণে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো বিভিন্ন নিরাপত্তা ইস্যুতে তাদেরকে কখনো রাশিয়াসহ শক্তিশালী পক্ষগুলো সমান হিসেবে বিবেচনা করেনি। কৌশলগত স্বাধীনতা না থাকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে ব্যাপক নির্ভরশীলতার কারণে কোনো আলোচনায় ইউরোপ বড় ভূমিকা রাখতে পারে না। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ইউক্রেনের যুদ্ধ এই সম্পর্ককে আবারও শক্তিশালী করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
তবে রাশিয়া যদি এই যুদ্ধে জয়ী হয়, তাহলে পুরো বিষয়টি অন্যরকম হবে। তখন স্থায়ীভাবে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ থেমে যাবে এবং রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগেরও সমাধান হবে। একইসঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও জাতীয় হিরো হয়ে উঠবেন। রাশিয়ার মধ্যে তিনি রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হবেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে তাদের শক্তি ও ফোকাস সব রাশিয়ার হুমকি সামলানোর পেছনে ব্যয় করতে হবে। এটি চীনের জন্য ব্যাপক সুবিধা নিয়ে আসবে। পশ্চিমারা যখন রাশিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তখন চীন তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতের জন্য আরো কিছু শান্তিপূর্ণ সময় পাবে। ইরাকের যুদ্ধও চীনের জন্য ভূরাজনৈতিক দিক থেকে একটি উপহারের মতো ছিল।
বিশ্বের ইতিহাস প্রচুর পরিবর্তন এবং অপ্রত্যাশিত পরিণতিতে ভরা। নতুন শক্তির উত্থান এবং তাদেরকে থামাতে পুরানো শক্তির চেষ্টার মধ্য দিয়েই বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়। চীনের উত্থান, চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা, নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলা, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড-১৯ এবং সর্বশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বিশ্ব ক্ষমতার রূপান্তর জোরদার হচ্ছে। চীনের এখনো তাইওয়ান ইস্যু সমাধান করা বাকি রয়েছে। পশ্চিমারা এখন একে ইউক্রেনের সঙ্গে তুলনা করছে। কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হলে চীন কখনো রাশিয়াকে তার কৌশলগত সহযোগী হিসেবে হারাতে চাইবে না। সাউথ চায়না পোস্ট