
সুব্রত বিশ্বাস ঃ লজ্জ্বাজনক নানা ঘটনা ঘটছে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে। নিউইয়র্কের সবচেয়ে প্রভাবশালী এ সংগঠনটি ভাঙ্গার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে একদল বিষাক্ত লোক। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনে সাংগঠনিক পরিস্থিতিত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্যের অঞ্চলবাসীর অগ্রসরজনদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত হস্তক্ষেপ করার। তৃতীয় পক্ষ যাতে বিদ্বেষের আবাদ না করতে পারে, এ নিয়ে এখন সোচ্চার নিউইয়র্কে বসবাসরত জালালাবাদবাসী।
সংঘাত আর ভাঙ্গন যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। একদফা সাধারণ সভা অনুষ্টিত হয়েছে গত সপ্তাহান্তে। সর্বশেষ নির্বাচনে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদককে সাধারণ সভায় স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। পাল্টা আরেকটি সাধারণ সভার প্রস্তুতি চলছে আসছে সপ্তাহান্তে।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলবাসীর ঐক্য ও ভালোবাসার সংগঠন জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন শুধু ভাঙ্গছেই এমন নয়। সৌহার্দ আর সহমর্মিতার অঞ্চলে হিসেবে দাবীদার বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ভাবমূর্তিকে তলানিতে পৌঁছানোর কাজ করছেন একদল আত্মঘাতী লোক। এদের হাত থেকে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন নামে সংগঠনকে রক্ষা করার তাগিদ এখন সর্বত্র। সংঘাত আর বিদ্বেষের আবাদ বন্ধ করে আউলিয়াকূল শিরোনমি হযরত শাহজালালের নামের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর আকুতি উচ্চারিত হচ্ছে। বিবাদমান পক্ষগুলোর বাইরে যাদের অবস্থান, তাদের নিয়ে ঐতিহ্যের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দাবী জানাচ্ছেন প্রবাসী জালালাবাদবাসীরা।

যেভাবে সমাধান হতে পারেঃ
নিউইয়র্কে বসবাসরত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার লোকজন সবাই সংগঠন না করলেও জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনকে তাদের সাংগঠনিক ছাতা হিসেবে মনে করেন। এসব লোকজন মনে করছেন, বিবাদমান উভয় পক্ষই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং অঞ্চলবাসীর জন্য দূর দেশে লজ্জ্বার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা জনসমাজের অগ্রসর এবং সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডাঃ জিয়াউদ্দীন আহমেদ, সুব্রত বিশ্বাস, প্রবীন সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ চৌধুরী( রানা চৌধুরী), সৌদ চৌধুরী, অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী সহ অন্যান্যদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এসব অগ্রসরজন উভয় পক্ষকে ‘বাইন্ডিং আরবিট্রেশন’ এর আওতায় এনে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার তাগিদ দেয়া হচ্ছে এবং এ নিয়ে তৎপরতাও শুরু হয়েছে।
নেপথ্য কথাঃ
জালালাবাদ বলতে বাংলাদেশের কোন অঞ্চল কোথাও নেই। ইতিহাসেও এমন কোন প্রমাণ নেই সিলেট অঞ্চলের কোন অঞ্চল জালালাবাদ নামে ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেট জেলা চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এ চার জেলার লোকজনের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য বিরাজমান। ‘সিলেটী ভাষায়’ তাঁরা কথা বলেন। পূর্ব বাংলার মানুষের প্রবাসযাত্রার অগ্রদূত এ অঞ্চলের মানুষ। আমেরিকায়ও এ অঞ্চলের মানুষজনই অভিবাসনের গোড়াপত্তনের পথিকৃৎ। নিজেদের মধ্যে ঐক্য, সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক বন্ধন এ অঞ্চলবাসীর অনন্য বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে চার জেলার লোকজন আমেরিকা সহ দেশে প্রবাসে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন নামে ঐক্যবদ্ধ থাকেন। নিউইয়র্কে দীর্ঘদিন থেকে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পরিচিত। একসময় অগ্রসর লোকজন এ সংগঠনের সাথে জড়িত থাকলেও ক্রমশ তাঁরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। নিজেদের বলয়ে ভোটার তালিকাভুক্তি করে সংগঠনের নেতৃত্ব দখল করে রাখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে গত এক দশক থেকে। অন্য আরও দু’দশটা আঞ্চলিক সংগঠনের মতো জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনও এখন হয়ে উঠেছে সংঘাত আর বিদ্বেষের আবাদে নিত্য ব্যস্ত থাকা কিছু মানুষের লীলাক্ষেত্র।

বর্তমান বিরোধের নেপথ্যেঃ
গত নির্বাচনে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম সাংগঠনিক নিয়ম লঙ্ঘন করে একটি বাড়ি ক্রয় করে জালালাবাদ ভবন নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন। সংগঠনের অর্থ যথাযত অনুমোদন ছাড়া উত্তোলন করে , নিজের অর্থও যুক্ত করে নিজের নামে ভবন ক্রয় করেছেন। এ নিয়ে সংগঠনের সভাপতি বদরুল খান সহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রকরা বেঁকে বসেছেন। সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা সমঝোতার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। সভাপতি বদরুল খান এবং সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলামের পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক লোকজন। এক পক্ষ মনে করেন , সংগঠনকে পাশ কাটিয়ে যে বাড়ি ক্রয় করা হয়েছে , সেখানে প্রচুর অনিয়ম রয়েছে। আর্থিক অস্বচ্ছতাও রয়েছে। এ বাড়ির সংগঠনের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। অন্যপক্ষ মনে করেন, যেভাবেই হোক একজন মঈনুল ইসলাম সংগঠনের নামে বাড়ি করে ফেলেছেন। এখন সাংগঠনিক নিয়ম অনিয়মকে পাশ কাটিয়ে হলেও বাড়িটি জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে উঠুক।

গত সপ্তাহের সাধারণ সভাঃ
১১ জুন রোববার কুইন্সের কুইন্স প্লাজায় অনুষ্ঠিত সাধারন সভা পরিস্থিতির কোন সমাধান এনে দেয়নি। বরং নাজুক করেছে। সভার শুরুতেই সাময়িক বহিস্কৃত সাধারন সম্পাদক মইনুল ইসলাম দলবল নিয়ে সভাস্থলে হৈচৈ শুরু করেন। সভাপতি বদরুল খান মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সভা পরিচালনা করার জন্য ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক রোকন হাকিমকে আহবান জানান। এ সময় ক্ষোভে ফেটে পড়েন মইনুল ইসলাম। তিনি পোডিয়ামের সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমি নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক। রোকনের ভারপ্রাপ্ততা অবৈধ। এ সময় মইনুলের কিছু সর্মথকও এগিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। মইনুল এক পর্যায়ে মাইকের ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে ফেলেন। শুরু হয় উভয় পক্ষের হাতাহাতি। কিছুটা পিছিয়ে আসেন মইনুল। রাগে ক্ষোভে তিনি দ্বিতীয় সারির টেবিলটি উল্টে ফেলে দেন। বদরুল খানের সর্মথকরা চড়াও হন মইনুল ও তার সর্মথক রনেলের ওপর। এক পর্যায়ে পুলিশের হস্তক্ষেপে মইনুল ইসলামকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। মইনুলকে অনুসরণ করেন তার সর্মথকরাও। বাইরে সমাবেশ করে তাঁরা সাধারণ সভাকে অবৈধ উল্লেখ করে ১৮ জুন রোববার সন্ধ্যায় কুইন্স প্যালেসে আরেকটি সাধারণ সভা আহ্বান করেছেন।
১১ জুনের সাধারণ সভার নানা ঘটনাঃ
প্রাইভেট সিকিউরিটি দিয়ে দেহ তল্লাসি করে লোকজনকে হলে পরবেশ করতে হয়েছে। জালালাবাদ অ্যাসোসিএশনের মতো একটি সামাজিক সংগঠনের সভায় এমন দেহ তল্লাসি করে প্রবেশের ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই। এমনকি সংবাদপত্রের লোকজনকে আমন্ত্রণ করেও দেহ তল্লাসির ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন অনেকেই।
এ নিয়ে সংগঠনের সভাপতি বদরুল খানকে জিজ্ঞেসে করা হলে তিনি বলেন জননিরাপত্তার জন্য হুমকি থাকলে , সাবধানতার জন্য সিকিউরিটি চেক একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা। নামে, বেনামে ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকেও জানানো হয়েছে। নির্দিষ্ট কাউকে অপমান করার জন্য সিকিউরিটি চেক করার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে বদরুল খান বলেছেন।
১১ জুন সাধারণ সভার বাইরে কিছু বিদশী লোক এবং গৃহহীন লোকদের ‘ঐক্য চাই – ভবন চাই’ ব্যানার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। বলাই বাহুল্য এসব লোকদের ভাড়া করেছিলেম মঈনুল ইসলাম। এ ঘটনাকে লজ্জ্বাজনক এবং সংগঠনের জন্য অপমানজনক বলে অনেককেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে মঈনুল বলেছেন, দাবিগুলো সঠিক। কে তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সেটা বড় বিষয় নয়। নাথিং ওয়াজ রং দেয়ার !

মঈনুলকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নিঃ
আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়েই সাধারণ সম্পাদক মঈনুলকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সাধারণ সভা চলাকালীন সাবেক সভাপতি রানা ফেরদৌস চৌধুরী এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক জুনেদ খান মঈনুলকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন। এ নিয়ে কোন আলোচনা না হওয়া প্রসঙ্গে বদরুল খান বলেছেন, সভায় প্রবেশ করেই যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ নেয়ার অবকাশ ছিল না সভায়।
বিয়ানীবাজার ফ্যাক্টরঃ
নিউইয়র্কে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন বিয়ানবাজার উপজেলাবাসীর কাছে জিম্মি বলে প্রচার রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে এ উপজেলার লোকজন ভোটার তালিকাভুক্তিতে এগিয়ে থাকেন। যারা জালালাবাদ সহ বাংলাদেশ সোসাইটির নেঋত্ব দেয়ার ইচ্ছে, তাঁরাই এসব ভোটার তালিকাভুক্তিতে ভূমিকা রেখে থাকেন। শুধু নিউইয়র্কে নয় প্রবাসের প্রতিটি শহরে সিলেটের বিয়ানীবাজারবাসীর মধ্যে আলাদা ঐক্য রয়েছে। যদিও নিউইয়র্কে এখন বিয়ানীবাজারের একাধিক নেতা উপজেলাবাসীকে নিয়ে বিবাদ বিভক্তিতে রয়েছেন। তবুও জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে সভাপতি বদরুল খান বিয়ানীবাজারবাসীর শক্তিতে পরিচালিত এবং যেকোন আলোচনায় তাঁর অনড় অবস্থানের এটাই শক্তি। এ নিয়ে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার প্রশ্নের উত্তরে বদরুল খান জানান, কোন এলাকার মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকাটা একটা ভালো বৈশিষ্ট্য। বিয়ানীবাজারের ভোটাররাই সাম্প্রতিক সময়ে এ উপজেলার বাইরের লোকজনকে বহুবার জালালাবাদের সভাপতি পদে নির্বাচিত করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিভেদের আবাদকারীরাঃ
নিউইয়র্কে কোন সংগঠন ভাঙ্গনের সম্মুখীন হলে কিছু চিহ্নিত লোকজনকে সক্রিয় হতে দেখা যায়। এরা কখনো কোন পক্ষ থেকে সুবিধা নেয়ার জন্য, কখনো নিজেদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের জন্যই বিভেদকে উস্কে দিতে সক্রিয় দেখা যায়। জালালাবাদের ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টির পেছনেও এমন লোজনের ইন্দন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, যারা একের পর এক সংগঠন ভাঙ্গে, ঐক্য ও সহমর্মিতার কথার বাণী তাদের কাছে পরিহাসের বিষয়। এসব লোকজনের তৎপরতার দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে সমস্যার আশু সমাধান আকাঙ্ক্ষা করছেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের নিউইয়র্কে বসবাসরত লোকজন।