সনজীবন কুমার
‘সব দায় এড়িয়ে ভালো থাকা যায় না।’ মনোজ মিত্রের পাখি নাটকের এটাই বোধ হয় ছিল নাটকের মূল বার্তা, অন্তত: আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। দেশে দেশে যুদ্ধের যে হিং¯্র হুঙ্কার,বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা,বিশ্বব্যাপী শ্রেণী বৈষ্যমের যে নগ্ন উৎসব চলছে তার দায় কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি ? নানা বিষয়ে আমরা যে ভাবে অস্থির সময় অতিক্রম করছি সেই প্রেক্ষাপটে মনোজ মিত্রের ‘পাখি’ নাটকটি মঞ্চায়ন ছিল অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ এবং সময়োপযেগি।
গত ২২ জুন জ্যামাইকা সেন্টার ফর আর্টস এন্ড লানির্ং-এ ড্রামা সার্কেল এই নাটকটি উপস্থাপনা করে।
পাখি নাটকের কাহিনী,সংলাপের ভাষা,দৃশ্য পরিকল্পনা ও চরিত্রচিত্রণ আকষণীয় এবং নান্দনিক ছিল। ছাপোষা এক চাকুরীজীবির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ,অভাবে জর্জরিত সরল ও কোমল প্রাণ এক নারীর হতাশা,অর্থনৈতিক শ্রেণী-বৈষম্যের বেদনা, অসহায় মায়ের মর্মবেদনা এই সব নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে নাটক সবলীল ভাবে এগিয়ে যায়। বিছানার চাদর থেকে বেদনার নীল কষ্টে একটি পাখি হারিয়ে যাওয়া নাটকটির কাহিনীর পরতে পরতে আমরা দেখি গভীর ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ অর্থ,কল্পনার ব্যাপ্তি ও হৃদয়গ্রাহী শিল্পময়তা।
পাখি নাটকে নিতিশ ( আবীর আলগীর) ও শ্যামার (কান্তা আলমগীর) দারিদ্রতা নিয়ে মনোজগতে দ্ব›দ্ব ও গভীরতম বেদনা মূর্ত হয়ে উঠলেও দম্পত্তি হিসেবে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখতে পাই। নাটকে উভয়ে পরস্পরের সাথে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে সম্পৃক্ত। যার জন্য তাদের মধ্যে একটা নিভুর্ল রোমান্টিক প্রবণতা ও ভাবালুতার উপস্থিতি সহজেই দর্শকদের মোহিত করেছে।
গোপালের ভ‚মিকায় চন্দন চৌধুরীর অভিনয় ছিল সাবলিল এবং অবশ্যই দর্শক নন্দিত। অসম্ভব সুুন্দর সংলাপ প্রক্ষেপণ ও মুন্সিয়ানা উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে চন্দন নিঃসন্দেহে উৎরে গিয়েছে। তাকে একজন জাত নাট্যশিল্পীই মনে হয়েছে।
জাফরিন আবেদীন চৈতালীর উপস্থাপনার কৌশল ছিল সীমিত এবং কিছুটা আরোপিত। তবে তার কন্ঠ মিলনায়তনের শেষ অব্দি গিয়ে পৌঁছেছে, সে দিক দিয়ে তিনি সফল হয়েছেন।
নাটকে ঘটনার চাইতে স্পর্শকাতর সংলাপ ও শারিরিক অভিব্যক্তি দর্শক-শ্রোতাদের বেশি আনন্দ ও তৃপ্তি দেয়। কিন্ত নাটকের শেষ প্রান্তে চিঠিটি পড়ার পর আবীর ,কান্তা ও চন্দন অভিনয় শৈলীতা ও কারুকার্যতা দেখার সুন্দর সুুযোগ হাতছাড়া করেছেন। এখানে তারা তিন আরও আবেগময় হতে এবং দর্শকদের হৃদয়ের অতল তলে স্পর্শ করতে পারতো।
আবীর আলমগীর ও কান্তার কিছু কিছু সংলাপ এতটাই ক্ষীণ কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে , যা নাটকের স্বাভাবিক গতিকে কিছুটা শ্লথ করে দিয়েছে। অবশ্য নাটকের শেষে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নার্গিস আহমেদ জানিয়ে দিয়েছেন, কিছু দিন আগে আবীর আলমগীরের হার্টে একটি গুরুতর অপারেশন হয়েছে। সে জন্যই হয়ত কখনও কখনও সংলাপ কিছুটা নিচু স্কেলে উচ্চারিত হয়েছে। কান্তা আলমগীরও অসুস্থতা নিয়ে মঞ্চে উঠেছেন বলে জানান নার্গিস আহমেদ। এই ঘোষনার পর নাটকপ্রিয় দর্শক অবশ্যই দুইজনের ক্ষীণ কন্ঠের উপস্থাপনাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন।
নার্গিস আহমেদ তার বক্তব্যে বলেছেন, আমরা সাতটার ট্রেন নয়টায় ছাড়ি নাই। সাতটার ট্রেন ঠিক সাতটাতেই ছেড়েছি,অর্থাৎ ঠিক সাতটাতেই নাটক শুরু করেছি।
দীর্ঘ চার মাসের প্রস্তুতি নিয়ে ৪৬ মিনিটের ‘পাখি‘ নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন জহির মাহমুদ। সার্বিক তত্ত¡াবধানে নার্গিস আহমেদ,প্রযোজনা অধিকর্তা রিপা আহমেদ,মঞ্চ ব্যবস্থাপনা এস কে বুখারি, আহব সংগীত ফারহানা তুলি আলক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ সুফিয়ান বিপ্লব এবং সঞ্চালনায় ছিলেন আদিবা জহির।
মঞ্চে খাট,চেয়ার-টেবিল ও বাজার খরচের ডালির ব্যবহার নাটকীয় হলেও আরোপিত মনে হয় নাই।
সব মিলে নাটকটি দর্শক-শ্রোতা ভালোভাবে পাতে গ্রহণ করেছে। যার জন্য নাটক চলার সময় বেশ কয়েকবার দর্র্শক করতালি দিয়ে অভিনয় শিল্পীদের অভিনন্দিতও করেছে। নাটক নিয়ে স্বপ্ন ঘোরের উৎস ভ‚মে ড্রামা সার্কল এগিয়ে যাক।