হাবিবুর রহমান : আমাদের পৃথিবী জীবন্ত ও নিয়ত সৃষ্টিশীল। আদি সংস্কৃতির মানুষের কাছে ধরিত্রী মাতৃসম। পৃথিবী স্বনিয়ন্ত্রিত, স্বচালিত এবং প্রাণীমণ্ডলীর উদ্ভাবক ও সৃজনকারী। প্রাণবৈচিত্র্য বিকাশের মাধ্যমে সে তার জলবায়ুর বিন্যাস ও লালন করে চলেছে। পৃথিবীর স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বচালিত আবহমান ধারা বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, বায়ুমণ্ডলের উপকরণ তৈরি ও সমুদ্রের নোনা জলসহ প্রাণবিকাশের সব উপদান সৃষ্টি করেছে। একই প্রক্রিয়ায় সে তার বহিঃভাগ বা ভূত্বক সৃষ্টি করেছে। ফলে প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তন ঘটছে। প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি বছর আগে প্রাণহীন পৃথিবীর উপরিভাগের তাপমাত্রা ছিল ২৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এর বায়ুমণ্ডলের ৯৮ ভাগ ছিল কার্বনডাই অক্সাইডের দখলে। শত শত কোটি বছরে পৃথিবী বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নিজেকে শীতল করে আজকের অবস্থায় এনেছে। যে প্রক্রিয়ায় পৃথিবী নিজেকে শীতল করে জীববৈচিত্র্যের বিকাশ ঘটিয়েছে, সেই একই প্রক্রিয়া জীবনকে টিকে থাকতে, পরিবেশ রক্ষা করতে, নতুন জীবন সৃষ্টি, জীবনভিত্তিক অর্থনীতি তৈরি করেছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা ইত্যাদি ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিয়ে আমরা ধরিত্রীর স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বচালিত জীবন প্রক্রিয়ার ক্ষতি সাধন করে চলেছি। এসব উপাদান পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যের প্রবাহকে অব্যাহত রাখার পক্ষে মারাত্মক হানিকর। আর এ কারণেই আমাদের পৃথিবী প্রায় ৬০ কোটি বছর পূর্বে জীবাশ্ম উদ্ভূত উপাদানগুলোকে ভূত্বকের গভীরে চাপা দেয়। যাতে এগুলো ওপরে উঠে আসতে না পারে। অথচ আমরা অর্থের লোভে সেসব মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদানকে পৃথিবীর ওপরে তুলে এনে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের মূল সমস্যাটি লুকিয়ে আছে উপনিবেশবাদের গভীরে; যা পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্য, সম্পদ, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার জন্য দায়ী। জীবন্ত পৃথিবী থেকে মৃত পৃথিবী একটি পরিবর্তিত বৈশ্বিক ধারণা। এ ধারণা আদিবাসীদের নিম্নজাতের মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং পৃথিবীতে বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে। এটি পরিবেশ বর্ণবাদের মতো ভ্রান্ত ও সভ্যতাবিরোধী মতবাদের সৃষ্টি করে ধরিত্রী ও মানুষের মাঝে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে। যে মতবাদ বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম ও জাতপাতের শ্রেণি বিভাজন করেছে, সেই একই মতবাদ মানুষের মাঝে ক্ষতিকর নৃকেন্দ্রিক কৃত্রিম বিভক্তিও তৈরি করেছে। ফলে একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের মাঝে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, বিশ্ব ভোগের বস্তু এবং তাকে নিজেদের ইচ্ছামতো করে দখল করে এবং ভাগবাটোয়ারা করে যেমন খুশি ভোগ ও লুণ্ঠন করা জায়েজ। পৃথিবী মৃত বা জড়বস্তু এমন ভ্রান্ত ধারণা জীবন্ত ও প্রাণফসলে পূর্ণ ধরিত্রীর জীবন্ত সত্তাকে অস্বীকার করে একে কাঁচামাল ও রসদ উত্তোলনের ভাগাড়ে পরিণত করেছে, যা দিয়ে বেনিয়ারা শিল্প ও কারখানার নির্মাণ করে জঞ্জাল ও দূষণের স্তূপে পাহাড় গড়ে তুলছে।
পৃথিবী মৃত একটি কাল্পনিক মতবাদ এবং উন্নয়নের উন্মাদনা তুলে এর সম্পদকে লুট, ধ্বংস ও শোষণের মহাযজ্ঞের সূত্রপাত পেছনে কাজ করছে। পৃথিবীর উৎকর্ষ ও এর প্রাণপ্রকৃতির সূক্ষ্ম জীবনচক্রের প্রতি আধুনিক প্রযুক্তি চোখ বুজে আছে। পৃথিবী জীবন্ত তা অস্বীকারের ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জলবায়ু ইঞ্জিনিয়ারিং, কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং। ধরিত্রীর সূক্ষ্ম, পরিশীলিত জীবনসৃজন কৌশল, নবপ্রাণ ও নবায়ন পদ্ধতির কাছে আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অনকোড়া ও ভোঁতা। বিশ্বে প্রভূত্বকারী অর্থনৈতিক মডেলের ভিত্তি হচ্ছে, বিপুল পরিমাণে কাঁচামাল ও নানাবিদ পদার্থ ব্যবহার পণ্য উৎপাদন এবং যার পরিচালন ব্যয় বিপুল। অন্যদিকে ধরিত্রীর উৎপাদন ব্যবস্থার খরচ শূন্য এবং এতে বাইরের ইনপুট লাগে না। ধরিত্রীর নিজস্ব উৎপাদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত দক্ষ ও জীবন্ত এবং কোনো ইনপুট ছাড়াই বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময় বস্তু, ফসল, খাদ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার প্রাকৃতিক সমাধান নিহিত আছে ধরিত্রীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন প্রয়াসের অন্দরে, এর জীববৈচিত্র্য, বৃক্ষরাজি, মৃত্তিকার অণুজীব, পরিবেশ প্রযুক্তি ও জীবন্ত অর্থনীতির মাঝে। বিভেদ ও শ্রেষ্ঠত্ব, লোভ ও নিয়ন্ত্রণ, মুনাফা ও ক্ষমতা, একচেটিয়া বাজার দখল ও আধিপত্য মানব প্রজাতির নির্বংশ হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা ধরিত্রী পরিবারের সদস্য এবং এর জীব-সমাহার দিয়ে তৈরি প্রাণ-জালিকার অংশ মাত্র, যা ভুলে যাওয়া হবে আত্মঘাতী। ধরিত্রীর খাদ্য ও জীববৈচিত্র্যের জালের বাইরে থেকে মানুষ বাঁচতে পারে না। বিভেদ, শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের মরীচিকা বিশ্বের জীববৈচিত্র্য চক্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে। যার ওপর টিকে আছে প্রাণ ও প্রকৃতি। প্রকৃতির কোনো সৃষ্টিশীলতা নেই, শুধু মানুষ বুদ্ধিমান এমন ধারণা ত্রুটিপূর্ণ, অচল ও উপনিবেশবাদী। এ চির নবায়নযোগ্য পৃথিবীতে যার কোনো স্থান নেই। কার্বন পরিশোধন ও পৃথিবীকে শীতল রাখতে বৃক্ষরাজি, অণুজীবপূর্ণ মাটির ক্ষমতাকে অস্বীকার করে কার্বন নিয়ন্ত্রণের নামে অর্থলোলুপ ও মুনাফালোভীরা নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ার প্রয়াস চালাচ্ছে-যা আর কিছুই নয় বরং দূষণের নতুন আয়োজন মাত্র। কার্বন হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন শিল্প পরিকাঠামো নির্মাণ, যেমন সবুজবিপ্লব, কারখানায় চাষবাস ইত্যাদি করা হচ্ছে-যা প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে টেকসই নয়। এসব করতে গিয়ে করপোরেটগুলো কৃত্রিমভাবে মুনাফা বাড়াচ্ছে। এসব করা হচ্ছে জনগণের অর্থ সাবসিডি হিসাবে ব্যবহার করে এবং পৃথিবীর প্রাণের মূল্যের বিনিময়ে। এসব মেকি জিনিস করে কার্বন নিয়ন্ত্রণ ও উষ্ণতা হ্রাসে পৃথিবীর নিজস্ব অতিসূক্ষ্ম ও অতি-উৎকর্ষ সক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এ ফাঁদে পড়েছে। আইপিসিসি বলছে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন শোষণ করা না যায়, তবে মানবজাতির পক্ষে ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়-যা বিশ্বের উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে আটকে রাখবে। কারণ শত-সহস্র কোটি ডলারের মালিক ধনিক শ্রেণি ও শিল্পপতিরা এখন অদক্ষ, প্রকৃতিবিরোধী, অতিমূল্য; কিন্তু দূষণের ভ্রান্ত সমাধানের ওপর বিনিয়োগ করছে। এর মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত শিল্পকারখানাকে আরও দূষণের সুযোগ দেওয়া হবে। তারা তাদের পণ্য আমাদের কাছে বিক্রয় করে মুনাফা অর্জন করবে এবং সেই অর্থলগ্নি করে নতুন কার্বন বাজার তৈরি করবে এবং এটাই হচ্ছে ধাপ্পাবাজির নেট জিরো অর্থনীতি।
প্রাকৃতিক বনস্পতি, বৃক্ষরাজি ও মাটির জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি রক্ষায় জনগণের করের অর্থ ও রাষ্ট্রের বিনিয়োগ সাধারণ মানুষদের স্বার্থ রক্ষা করবে। এর মাধ্যমে মানুষের পেশা, কাজ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে চক্র অর্থনীতি বিকশিত হবে। এ সত্য সহজে গ্রহণই পারে বসুন্ধরাকে জীব ও প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য হিসাবে টিকিয়ে রাখতে।
সুইজ কোম্পানি ক্লাইমওয়ার্ক আইসল্যান্ডে ওরকা নামে একটি কার্বন পরিশোধক শিল্প স্থাপন করেছে। কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এক টন কার্বন পরিশোধন করতে ওরকার ব্যয় হবে ৬০০ মার্কিন ডলার। এই হিসাবে এক বছরে পুরো মানবজাতি যে পরিমাণ কার্বন উৎপাদন করছে, তা শোধনে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। গোটা পৃথিবীর কার্বন শোষণ করতে অন্তত ৫০ হাজার ওরকা প্লান্ট বসাতে হবে। তবে ক্লাইমওয়ার্ক আশা করছে এ ব্যয় কমিয়ে ১০০ ডলারে নামিয়ে আনা সম্ভব। যদি পরিশোধনের জন্য ধারণকৃত কার্বন বেভারেজ কোম্পানিগুলোতে বিক্রি করা যায়। উল্লেখ্য, কার্বনডাই অক্সাইড কোমল পানীয় তৈরির অন্যতম উপকরণ। এর মানে দাঁড়ায়, স্থুলতা, ডায়াবেটিস ও নানাবিধ জটিল রোগের জন্য সদর দরজা খুলে দেওয়া। এটি পৃথিবীর মানুষকে রোগী বানিয়ে ছাড়বে।
ধারিত্রীক প্রযুক্তি গাছের সবুজ পাতার ভেতরে লুকিয়ে থাকে এবং সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অনেক সূক্ষ ও কার্যকরভাবে কার্বনডাই অক্সাইডকে পরিশোধন করে। প্রকৃতি বিনা পয়সায় কার্বন রিসাইকেল করে অক্সিজেনে রূপান্তর করছে, খাদ্য, ফলমূল উৎপাদন করছে, মাটিকে জীবন্ত রাখছে, প্রাণ ও ফসলের জন্ম দিচ্ছে, জল সঞ্চিত রেখে নদীনালা, ঝরনা, কূপকে নিরন্তর পানি জগিয়ে যাচ্ছে। আর এসব প্রকৃতি করে যাচ্ছে একেবারে বিনা মাশুলে।
মনে রাখতে আমাদের পৃথিবী জীবন্ত এবং আমরা এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধরিত্রী জন্য অনিষ্টকর নয় এমন কিছু না করে এর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ পন্থায় আমাদের জীবনযাপন করতে হবে। আমরা যেন না ভাবি আমরা পৃথিবীর মনিব। মানবজাতিকে এমনভাবে জীবন ও কর্ম করে যেতে হবে যাতে বসুন্ধরা চিরহরিতের সমারোহে চারদিক ভাসিয়ে দিতে পারে-যা সে বহু কোটি বছর ধরে করে আসছে। স্মরণ রাখা দরকার, বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে আর কোনো বাসযোগ্য গ্রহ এখন অব্দি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হাবিবুর রহমান : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন কর্মী