সাইফ সুজন
সন্ধান ডেস্ক : বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শুধু নাই আর নাই। সব কিছু শুণ্য । প্রায় এক দশক ধরে শূন্য উপাচার্য পদ। প্রতিষ্ঠার পর দুই যুগ পেরোলেও কখনই নিয়োগ দেয়া হয়নি উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, প্রক্টর ও গ্রন্থাগারিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও স্থায়ী কোনো কর্মকর্তা নেই।
পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত—এমন বিভাগও পরিচালিত হচ্ছে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে। নামসর্বস্ব এমন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়েই বছরের পর বছর হাজারো শিক্ষার্থীকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি দিয়ে আসছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটির এ ধরনের নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তেও।
অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা কর্তৃত্ব ধরে রাখতে স্থায়ী ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ দিচ্ছেন না। উল্টো নিজেরাই প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদ দখলে নিয়েছেন। বিওটির চেয়ারম্যান নিজেই অনুষদের ডিন, ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেলের (আইকিউএসি) পরিচালক ও বিভাগীয় শিক্ষকসহ নানা পদের দায়িত্বে বিওটির সাবেক একজন চেয়ারম্যান ও বর্তমান সদস্য নিজেকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য পরিচয় দিচ্ছেন।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের ১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিদর্শনে যান ইউজিসির পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি। সরেজমিন তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ওই পরিদর্শক দল। প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
ইউজিসির ওই পরিদর্শনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির একাডেমিক কার্যক্রমের চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৩টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে ভর্তি শিক্ষার্থী সংখ্যা আনুমানিক ছয় হাজার। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রোগ্রামেই ন্যূনতম যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক নেই বিএড ও এমএড প্রোগ্রামে প্রায় ১০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এসব শিক্ষার্থীর পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। বিএড ও এমএড প্রোগ্রামে শিক্ষকতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যদিও একমাত্র শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। একইভাবে বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের প্রতিটিতে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন করে। ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। যদিও ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রোগ্রামে কমপক্ষে চারজন স্থায়ী শিক্ষক থাকতে হবে। এর মধ্যে একজন কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিদর্শন কমিটি ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক অনিয়ম দেখতে পাই। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ন্যূনতম যে জনবল কাঠামো প্রয়োজন, সেটির ধারেকাছেও নেই বিশ্ববিদ্যালয়টি। আইন ও নীতিমালা পরিপালনের জন্য যে নেতৃত্ব দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সেসব পদে পূর্ণকালীন কাউকে নিয়োগই দেয়া হচ্ছে না। পাঁচ-ছয়শ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক, তাহলে সেখানে উচ্চশিক্ষা কীভাবে সম্ভব? ট্রাস্টি সদস্যরা অনিয়ম করে বিভিন্ন পদে বসে রয়েছেন। বছরের পর বছর কোনো অডিট নেই। কোনো ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলাই নেই। অনিয়ম বন্ধে আমরা প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করেছি।
প্রশাসনিক অনিয়ম বিষয়ে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেয়া উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নেই। বিওটির চেয়ারম্যান একই সঙ্গে নিজেই অনুষদের ডিন, আইকিউএসি পরিচালক ও বিভাগের নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বৈধ উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থায়ী জনবল না থাকার সুযোগে আর্থিক অনিয়ম করার অভিযোগ বিওটি সদস্যদের বিরুদ্ধে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আর্থিক অনিয়ম বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে অধিকাংশ অর্থবছরেই বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়-ব্যয়ের হিসাব অডিট ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষা করা হয়নি। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। এছাড়া আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ভ্যাট-ট্যাক্স ও বিলের কপিসহ ক্যাশ বই সংরক্ষণ করা হয় না।
সাতটি প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তিতে ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা: এদিকে কমিটির দেয়া প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে বেশকিছু ব্যবস্থা নিয়েছে ইউজিসি। গত রোববার ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রারকে এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে পাঁচটি বিভাগের সাতটি প্রোগ্রামে স্প্রিং সেমিস্টার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখতে বলেছে ইউজিসি। প্রোগ্রামগুলো হলো বিএ (অনার্স) ইন বাংলা, এমএ ইন বাংলা, এমএসএস ইন ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট, বিএ (অনার্স) ইন ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, এমএ ইন ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, বিএড ও এমএড।