খুশী কবির
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নারী সমাজকে শুধু নয়, বৃহত্তর নাগরিক সমাজকেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। নোয়াখালীতে একজন নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়েছে। সিলেটে এমসি কলেজের হোস্টেলে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শিশু, কিশোর, যুবতী, বিবাহিত, অবিবাহিত এমনকি বৃদ্ধ নারীও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। নিজ বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, পর্যটনকেন্দ্র সর্বত্রই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। ঘটনাগুলো নারীকে এই বার্তা দেয় যে- নারী তুমি শুধুই পণ্য। এ পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমাদের সমাজপতিরা দায়ী।
বিশেষত নোয়াখালীর সর্বশেষ ঘটনাটি যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে ওই নারীকে নির্যাতন করা হয় এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। আমি একই সঙ্গে বিক্ষুব্ধ ও বিস্মিত যে, এতদিন এ নিয়ে জাতীয় স্তরে দূরে থাক, স্থানীয় পর্যায়েও কোনো টু শব্দটি হয়নি। নারীর সল্ফ্ভ্রম ও নাগরিকের মর্যাদা এতটাই মূল্যহীন?
মন্দের ভালো, নির্যাতনের সেই ভিডিও এক মাস পর ভাইরাল হওয়ার পর প্রশাসন সক্রিয় হয়েছে এবং গত রোববার রাতে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী নারী। সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের পর ওই নারীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিল অপরাধীরা। অন্যথায় তারা বারবার তাকে ভিডিওটি ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেয়। শেষ পর্যন্ত ওই নারী অনৈতিক প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় ভিডিওটি ভাইরাল করা হয়।
আইনের প্রতি জনগণের আস্থা কতটা কমে গেছে, তা এ ঘটনাটি বিশ্নেষণ করলেই বোঝা যায়। ঘটনার এক মাস পর ভিডিওটি ভাইরাল করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগী থানায় যাননি। কী কারণে তিনি থানায় যাননি? ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরই কেবল পুলিশ তৎপর হয়েছে। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, নোয়াখালীর মতো এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটে। এর মধ্যে অল্প কিছু ঘটনা আমরা জানতে পারি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় যান না। আবার কেউ কেউ থানায় গেলেও মামলা করতে পারেন না। আবার কোনোমতে মামলা হলেও আসামি গ্রেপ্তার হয় না। ফলে ন্যায়বিচার তথা অপরাধীর শাস্তি অধরাই থেকে যায়।
অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত অথবা তাদের যথেষ্ট অর্থ আছে, যা দিয়ে তারা তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারে বা তাদের অপরাধকে দুর্বল করে ফেলতে পারে। আমরা দেখছি একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে। এর জন্য মূলত দায়ী জনগণের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত বাহিনীর দুর্বলতা ও উদাসীনতা।
আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে নারীর প্রতি সহিংসতায়ও রীতিমতো উস্কানি দেওয়া হয়। সরকারের উচিত এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য-কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে বন্ধ করা। কিন্তু আমরা দেখি পর্নোগ্রাফি সাইট বা নারী নির্যাতনকে উস্কে দেয়, এমন কর্মকাণ্ডে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার না করে বরং কে কোন জায়গায় দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছে, তাকে এ আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তার মানে আপনি যদি নাগরিক দায়িত্ব পালন করেন, প্রশ্ন তুলে জবাবদিহি চান, তাহলে আপনি সমস্যায় পড়বেন। আর আপনি যদি অপরাধ করেন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব খাটাতে পারেন, তাহলে আপনাকে কিছুই বলবে না। ফলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।

স্বীকার করতে হবে, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু কিছু ঘটনা বাংলাদেশের অর্জনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা দেখেছি কভিড-১৯ মহামারি চলাকালে কভিডের জাল সনদ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে অভিবাসীদের হাতে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে সাংঘাতিকভাবে। এ ধরনের জঘন্যতম অপরাধের পরও অপরাধীরা মনে করে তারা পার পেয়ে যাবে। যারা এ অপরাধগুলোকে বিচার প্রক্রিয়ায় দাঁড় করাবে, তাদের সঙ্গে অপরাধীদের সখ্য থাকে।
আমাদের দেশে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই সরকারকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে নারী নির্যাতন রুখে দাঁড়াতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্ব থাকে সব ধরনের অপরাধকর্মকে রুখে দেওয়া। কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো। বিচার বিভাগের কাজ কেউ কোনো অপরাধ করলে তার বিচার যেন সঠিকভাবে হয়। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ জনগণের নিরাপত্তা, বেঁচে থাকা, চলাফেরার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে। একটি বিভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিতে আর অন্যটি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মানুষের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করে।
এ দুটি বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়লে, মানুষের আস্থা না থাকলে এবং মানুষ যদি মনে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা দেবে না, আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না, তখন অপরাধীরা অপরাধকর্মে আরও বেশি উৎসাহিত হয়; কারণ তারা জানে যে, তারা পার পেয়ে যাবে।
এও মনে রাখতে হবে, যখন গণতন্ত্র সঠিকভাবে চর্চা করতে দেওয়া হয় না বা গণতান্ত্রিক চর্চা দুর্বল হয়ে পড়ে, জবাবদিহি থাকে না, ন্যায্যতার অভাব দেখা দেয়; তখনই এ ধরনের অপরাধ ঘটতে থাকে। আমরা দেখেছি যেসব দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, যেখানে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, সেখানে অপরাধের মাত্রা বাড়তেই তাকে। আমার অনুরোধ, প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতারা যেন এসব বিষয়ে কঠোর হোন।
এ ধরনের ঘটনায় কঠোর বার্তা দেওয়া উচিত যে, কোনো ব্যক্তি যদি এ ধরনের অপরাধে লিপ্ত হন তিনি রাজনৈতিকভাবে যে অবস্থানেই থাকুন না কেন তাকে শাস্তি দিয়ে আইনের শাসন বলবৎ রাখা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে কিছু ঘটনা খুব বেশি আলোচিত হয় এবং জনগণ সোচ্চার হয়ে ওঠে। এসব ঘটনায় আসামি দ্রুত গ্রেপ্তার হয়। নিম্ন আদালত দ্রুত রায়ও দেন। এরপর উচ্চ আদালতে সে মামলা চলে বছরের পর বছর। অনেক আসামি জামিনে মুক্তিও পান। আমাদের দেশে এ ধরনের মামলাগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন সরকারি আইনজীবী (পিপি)। পিপি নিয়োগ পান রাজনৈতিক পরিচয়ে, তারা অনেক সময় জনগণের স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থকেই বড় করে দেখেন। সঙ্গত কারণে এ ধরনের মামলা পর্যবেক্ষণ হওয়া উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি গির্জার পাদ্রিও ধর্ষণ করেছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন বন্ধ করতে হলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারী ও পুরুষকে সমানভাবে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। যারা ধর্ষণ করে তারা মানুষ নয়। তারা নিজেকেই সম্মান করতে জানে না। তারা সমাজের কলঙ্ক, সমাজে বসবাসের যোগ্য নয়। এ ধর্ষকশ্রেণির বিচার যেমন করতে হবে, তেমনি নারীর অস্তিত্বের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা দিতে হবে। নারীকে দুর্বল করে রাখার সামাজিক ব্যাধি দূর করতে হবে সবার আগে।
সমন্বয়ক, নিজেরা করি