নিউইয়র্কে কোটা বিরোধি নজিরবিহীন প্রতিবাদ সমাবেশ

হাসান মাহমুদ : বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে যায় নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে। এছাড়া জাতিসংঘের সামনে, নিউইয়র্ক কনসুলেটের সামনে, জ্যাকসন হাইটস ডাইভারসিটি, জ্যামাইকায় এবং প্যানসেলভিনিয়া স্টেইটে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা যায়। মুহূর্মুহু  শ্লোগানে টাইমস স্কয়ার, ব্রডওয়ের বিশাল এলাকাজুড়ে বাংলাদেশ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছে। ‘সেভ বাংলাদেশি স্টুডেন্টস’ এর ব্যানারে গত ১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার এবং ২১ জুলাই রোববার বাংলাদেশে আন্দোলনরত কয়েকশত শিক্ষার্থীকে হত্যার প্রতিবাদে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

প্রথম দিন টাইমস স্কয়ারে বিকেল থেকে কয়েক হাজার মানুষের স্বতস্ফূর্তভাবে সমাগম ঘটে। বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে অতিতে টাইমস স্কয়ারে আয়োজিত যে কোন অনুষ্ঠানের চেয়ে লোক সমাগমে আলাদা নজির স্থাপন হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। প্রথম দিন বিকেল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে ঝাকে ঝাকে মানুষ জড়ো হতে থাকেন। রাত ৯টার পরও সমাবেশ চলমান ছিল। ব্রডওয়ের বিশাল এলাকা জুড়ে শ্লোগানে আর ব্যানার নিয়ে আসা মানুষের ভিড় সামলাতে এনওয়াই পিডির বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

বিক্ষোভকারীরা ট্রাইমস স্কয়ারের সামনে এসে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। বিক্ষোভকারীরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’ ‘আমি কে, তুমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ ‘আমার ভাই মরলো কেন জবাব চাই’ ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এমন বহু ¯শ্লোগানে শ্লোগানে  মুখরিত করে রাখে পুরো টাইমস স্কয়ার। এমন গগনবিদারি আওয়াজ টাইমস স্কয়ারে আগে কখনো হয়েছে এমনটা কেউ স্মরণ করতে পারেননি। প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আসা নিউইয়র্কের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। কেউ কেউ নিউজার্সি থেকেও এসেছিলেন বলে জানান। গত এক বছর আগে তারা বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে এসেছেন। এছাড়াও সপরিবারে বিভিন্ন পেশাজীবী, বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতৃস্থানিয়দের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো।

বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে টাইমস স্কয়ারে দু’বার আয়োজিত এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজনের পেছনে কাজ করেছেন জ্যামাইকাবাসি শিক্ষার্থী নাফিসা সৈয়দা। তিনি ‘সাপ্তাহিক আজকাল’কে বলেন, ‘জ্যামাইকার ১৬৯ স্ট্রিট হিলসাইডের বোম্বে গ্রাফিক্সে আমরা কয়েকজন মিলিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশে যেভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হচ্ছে তার তীব্র প্রতিবাদ আমরা কিভাবে জানাতে পারি তাই ছিল আলোচনার বিষয়। প্রথমে আমরা কয়েকজন ফেসবুক গ্রুপে সমাবেশের ঘোষণা দেই। ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। নাফিসা সৈয়দা বলেন, ‘আমাদের কোন সংগঠন নেই। আমার ইনস্টাগ্রামে ২০ হাজার ফলোয়ার আছেন। আমি প্রথমে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাই। আমাকে সহযোগিতা করেছেন মোহাম্মদ তানভির ইসলাম, দীনা সৈয়দা, নওশিন আহমেদ তিশা, কামরুন নাহার লুনা, আরেফিন মোশাহিদ কল্লোল এবং লামিম। টাইমস স্কয়ারে আমাদের এই প্রতিবাদ সামাবেশের আয়োজনের পেছনে ব্যানারসহ অন্যান্য স্পন্সর করেছেন বাহালুল সৈয়দ উজ্জ্বল।

নাফিসা সৈয়দা বলেন, আমরা ভাবতেই পারিনি কয়েক হাজার মানুষ এই সমাবেশে বিভিন্ন পোস্টার ও ব্যানার নিয়ে অংশগ্রহণ করে আলোড়ন তুলবেন। অনেকে সপরিবারে এসেছেন বাংলাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভ ও নিন্দা জানাবার জন্য। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে তা কারো জানা নেই। আমরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রতিবাদ জানাবার জন্য এমন আরও সমাবেশের আয়োজন করবো।’

গত ১৯ জুলাই শুক্রবার ম্যানহাটনের জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল ২৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সামনে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা আড়াইটা থেকে তিনঘণ্টাব্যপী বিক্ষোভ করেন ছাত্রসহ সর্বস্তরের বাংলাদেশিরা। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ‘ছাত্ররা ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করেছে। কিন্তু এই আন্দোলনকে দমন করতে সরকারি দল, তাদের ছাত্রলীগ এবং পুলিশ, র‌্যাব বাহিনী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অমানবিক অত্যাচার, জুলুম এবং নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইল সংযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়। কতজন আহত এবং নিহত হয়েছেন তার হিসাব কারো জানা নেই।’ সমাবেশে উপস্থিত বাংলাদেশি আমেরিকান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী আজকালকে বলেন, আমরা জাতিসংঘ মহাসচিব এবং মার্কিন সরকারকে এই সামবেশ থেকে আহবান জানিয়েছি বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে, ছাত্র নিপিড়ন হচ্ছে এমন ঘটনা অবিলম্বে প্রতিরোধ করার জন্য।’

১৭ জুলাই দুপরে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনসুলেটের সামনে বিক্ষোভ করে নিউইয়র্কের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শতাধিক শিক্ষার্থী। দুপর ১ টা থেকে প্রায় আড়াইটাব্যাপি এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কনসুলেটে থাকা ব্যক্তিরা পুলিশ ডাকার হুমকি দেন। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। পুলিশের উপস্থিতে ছাত্ররা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভ শেষে বিক্ষোভকারীদের দুই সদস্যের প্রতিনিধি কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

গত ১৯ জুলাই শুক্রবার নিউইয়র্ক কনসুলেটের সামনে মানববন্দন করে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতা কর্মীরা। ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় জ্যামাইকার ১৬৮ স্ট্রিট হিলসাইড এভিনিউতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানবন্ধন করেন প্রবাসি বাংলাদেশি ছাত্র, ব্যবসায়ি ও স্থানীয় অধিবাসীরা।

গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার আটলান্টায় গেøাবাল মলের সামনে স্থানীয় বাংলাদেশী ছাত্ররা মানববন্ধনের আয়োজন করে। সন্ধ্যা ছয়টায় মিশিগানেও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা যায়। গত বুধবার বিকেলে ফিলাডেলফিয়ার সিটি হলে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে মানববন্ধনের আয়োজন করেন ছাত্ররা। বাংলাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানাতে ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল, ড্রেক্সেল, ইউপেনসহ অন্যান্য কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।

Exit mobile version