উপ-সম্পাদকীয়
।। আবু আফিয়া আহমদ ।।
ভাস্কর্যের বিষয়ে পবিত্র কোরআন-হাদিসে দিকনির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা নবী-রাসূলদের ঘটনার বিষয়ে একটি নীতিগত শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, নিশ্চয় তাদের (নবী-রাসূলদের) ঘটনাবলির মাঝে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ১১১)। কোরআন শরিফে আল্লাহর নবী হজরত সোলায়মান (আ.)-এর সাফল্য ও বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ইয়া’মালুনা লাহু মা ইয়াশাউ মিম মাহারীবা ওয়া তামাসীলা অর্থাৎ তারা তার ইচ্ছে অনুযায়ী প্রাসাদ ও ভাস্কর্য বানাত… (সুরা সাবা, আয়াত : ১৩)। এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়, হজরত সোলায়মান (আ.)-এর আমলে তার জন্য ভাস্কর্য বানানো হতো। আর এ শিল্পশৈলী ও নিপুণ প্রযুক্তি লাভের জন্য এ আয়াতেই আল্লাহতায়ালা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করারও নির্দেশ দিয়েছেন।

ভাস্কর্য মাত্রই যদি শিরক হতো তাহলে আল্লাহর পবিত্র নবী হজরত সোলায়মান (আ.) কখনই তা করতে পারতেন না। কেননা সব নবী-রাসূলই মূলত শিরক দূরীভূত করতে আসেন। অন্যান্য শিক্ষা ও বিষয়াদিতে তারতম্য থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু সব নবী শিরকের বিরুদ্ধে একই অবস্থান ও শিক্ষা প্রদান করেন।
মূর্তি বা ভাস্কর্য মাত্রই শিরকের উপকরণ- এমন কোন কথা নেই বরং যেটি যে উদ্দেশ্যে বানানো হয় সেটিকে সেভাবে বিবেচনা করতে হবে। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) রাসূল (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। তার (রা.) কয়েকটি পুতুল ছিল বলে হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি (রা.) তার বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে এসব পুতুল দিয়ে খেলা করতেন। কই, মহানবী (সা.) তো শিরক বলে এসব পুতুল নিয়ে খেলতে বারণ করেননি? আবার, এসব পুতুল যেহেতু শিরকের উপকরণ তাই আমি এ পুতুলগুলো দিয়ে খেলা বন্ধ করে দিলাম- একথাও হজরত আয়েশা (রা.) কখনও বলেননি। রাসুলুল্লাহর বাসগৃহে পুতুলের অবস্থান স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে পুতুল বা ভাস্কর্য মাত্রই শিরকের উপকরণ নয়।
কট্টর ওয়াহাবিপন্থিরাও এটি জানেন, প্রাণীর ভাস্কর্য মানেই শিরক নয়। সৌদি আরবের জেদ্দার মূল কেন্দ্রে দি ফিস্ট নামের একটি ভাস্কর্য আছে, এটি একটি মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ভাস্কর্য। আরও আছে ঘোড়ার ও মাছের ভাস্কর্য। একইভাবে মুসলিম অধ্যুষিত দুবাই ও ইরানে রয়েছে ঘোড়া ও অন্যান্য জীবের ভাস্কর্য। প্রমাণিত হলো, ভাস্কর্য জীবদেহের হোক বা জীবদেহের কোন অংশের হোক তা যদি শিরক বা পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত না হয় তবে এতে কোন বারণ নেই।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে সমাবেশ করেছে ধর্মীয় নেতারা। হেফাজতে ইসলামের নব্য আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী, চরমোনাইর পীর ও ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম, হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হকসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করছেন। তাদের দাবি মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল না হওয়া পর্যন্ত ‘তৌহিদি জনতার’ আন্দোলন চলবে। গোঁড়া তালেবানি ভাবধারায় ভাস্কর্য নির্মাণ। নিষিদ্ধ হেফাজতিরা সম্পূর্ণভাবে অ-ইসলামী সেই ভাবধারা প্রবর্তনের কথা বলছে। হেফাজতিরা যদি সত্যিই ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধী হয়ে থাকেন তবে এর প্রমাণ তারা তাদের হাটহাজারীর কাছেই অবস্থিত খাগড়াছড়িতে প্রদর্শন করতে পারেন। খাগড়াছড়ি শহরের দ্বারপ্রান্তে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি বৃহাদাকার ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। মানুষের এ মূর্তিটি ভেঙে এরা প্রমাণ করতে পারেন এ বিষয়ে তারা কতটা সিরিয়াস।
অনেকে বলে থাকেন হজরত সোলায়মান (আ.)-এর যুগে মূর্তি বানানোর অনুমতি থাকলেও ইসলামের যুগে তা রহিত হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে সত্যিকার বক্তব্য হলো, একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা ও শিরক পরিহার করাই হচ্ছে সব যুগের সব নবীর মৌলিক শিক্ষা, এতে কোন ব্যতিক্রম নেই। অতএব তখন হজরত সোলায়মান (আ.)-এর যুগে মূর্তি বানানো আর যাই হয়ে থাক শিরক হতে পারে না। তাই এদের এ দাবি ধোপেও টেকে না। মোদ্দা কথা হলো, মূর্তি ও ভাস্কর্য যে উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে সেই উদ্দেশ্য নির্ধারণ করবে এটি বৈধ নাকি অবৈধ।
হেফাজতিদের শিরকের বিরুদ্ধে আন্দোলন- চমৎকার কথা। বিজাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান- খুব ভালো কথা। তার আগে হেফাজতিদের কাছে আমাদেরও কিছু জানার আছে। এই যে ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার নামে লংমার্চ, অবরোধ, কুশপুত্তলিকা দাহ, হরতাল, ভাঙচুর- এসব কি অ-ইসলামী সংস্কৃতি নয়? জাতি বলতে মুসলিম জাতি বুঝিয়ে থাকলে প্রথমে আপনাদেরকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আর আপনারা যদি ‘বিজাতীয়’ বলতে বিদেশি তথা অবাঙালি সংস্কৃতি বুঝিয়ে থাকেন তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আন্দোলনকারী গোষ্ঠী নিজেরা কতটুকু এ বিষয়ে আমল করছেন? আপনাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে কি নিয়মিত জাতীয় সঙ্গিত গেয়ে দিনের কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়? আপনাদের পোশাক ও বেশভূষায় কতটা বাঙালিয়ানা প্রকাশ পায় তাও সবারই জানা। মাতৃভাষা বাংলাকে কি আপনারা সব কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন? আপনারা আরবি-উর্দু বলেন স্পষ্টভাবে, অথচ আপনাদের বাংলা উচ্চারণ শুনলে আমাদের শিশুরাও লজ্জা পায়! এক্ষেত্রে দু’চারজন ব্যতিক্রম থাকতেই পারেন। কিন্তু সাধারণভাবে যে অবস্থা গোচরীভূত ও প্রতিভাত হয় তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে আপনারা নিজেরাই জাতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুশীলন করেন না। আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও। তাই মিছিল-আন্দোলনে নামার আগে আপনাদের নিজেদের অবস্থা শুধরানো আবশ্যক বলে মনে করি।
মহানবী (সা.) মানুষকে বুঝিয়ে, তাদের মন জয় করে সৎপথে এনেছিলেন। সত্য ও সুন্দর পালন করতে মিছিল-আন্দোলন করেননি, আইনও পাস করেননি। আপনারাও তার পথ ধরে এগোন।

‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা’ আপনাদের দাবি। প্রথমেই বলে নিই, ইসলাম ধর্ম শুধু ইসলামের নয় বরং সব ধর্মমত ও মতবাদের সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করে। ধর্মীয় মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সব মত ও পথের অনুসারীদেরকে ইসলাম সমান নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার প্রদান করে। জঘন্যতম আধ্যাত্মিক অপরাধ শিরক করার এবং সমাগত সত্যকে অস্বীকার করারও জাগতিক ও ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষা করে (সুরা আনআম-এর আয়াত ১০৮, সুরা কাহাফের আয়াত ২৯ প্রভৃতি দ্রষ্টব্য)। একইসঙ্গে পবিত্র কোরআন একথাও বলে, ধর্ম বিষয়ে মতপার্থক্যের বিচার হবে কিয়ামত দিবসে, ইহকালে নয়। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে যে স্পষ্ট শিক্ষা রয়েছে তা খোদাভীরু হাক্কানী আলেম-উলামা বেশ ভালোই জানেন। এ সত্ত্বেও সব ধর্মের ও মতবাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে কথা না বলে শুধু ‘ইসলাম গেল- ইমান গেল’ বলে দাড়ি-টুপি আর আলখেল্লার সম্মান আদায় করা আর যাই হোক, ইসলামের খাঁটি অনুসারীদের শোভা পায় না।
দাড়ি-টুপি কি শুধু ইসলামের রেজিস্টার্ড ট্রেড মার্ক? পাগড়ি, পাঞ্জাবি-পায়জামা কি শুধু মুসলমানরাই পরে, অন্য মতাবলম্বীরা কি এসব পরে না? ভারতীয় নেতা নেহরুও টুপি পরতেন। অপরিকল্পিত বিবর্তনবাদ তথা নাস্তিক্যবাদের প্রচারক ডারউইনের দাড়ি এবং সেই দাড়ির দৈর্ঘ্য নিয়ে কি কারও মনে সংশয় রয়েছে? আলখেল্লা বা জুব্বা আরবের খ্রিস্টান-ইহুদিরাও তাদের জাতীয় ও আঞ্চলিক পোশাক হিসেবে অহরহ পরছে। পূর্ব পাঞ্জাবের গুরুদুয়ারাগুলোতে শিখ মতাবলম্বীদের দাড়ি ও পাগড়ি দেখলে এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। স্পষ্ট বোঝা গেল, ‘দাড়ি-টুপি-আলখেল্লা’ মুসলমানদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয় আর তাই এ নিয়ে বাড়াবাড়িরও কোন সুযোগ নেই।
আসল কথাটা কেউ মুখ ফুটে বলতে চায় না। একটি দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সেই দেশের প্রকৃতি, জলবায়ু, ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরই ধারক-বাহক হয়ে থাকে। এটি আইন করে চাপিয়ে দেয়া যায় না আবার কৃত্রিমভাবে সৃষ্টিও করা যায় না। বাংলাদেশের সামাজিক ও জাতীয় জীবনে যে সব অধ্যায় পার করে জাতি আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে এক শ্রেণীর হুজুরদের বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা সর্বজনবিদিত।
’৭১-এর আগে, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক শ্রেণীর তথাকথিত আলেম-উলামা যা করেছেন এর কারণে সমাজে তাদের সম্বন্ধে স্বাভাবিকভাবেই একটি নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান। আর এরই স্বাভাবিক প্রতিফলন ঘটে থাকে আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও গণমাধ্যমে। রাজনৈতিক অঙ্গন বাদ দিলেও সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে এক শ্রেণীর হুজুররা এখনও যা করে যাচ্ছেন সেটাও বা কম কিসের? পানি-পড়া, তাবিজ-কবচ, শিরনি-মানত, কোরআন খতম, তালাক, হিল্লা-বিয়ে, কুলখানি, বখশায়ে দেয়া, নামাজের কাফফারা ইত্যাদি নামে কত কী চলছে আমাদের দেশে! এসবের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিফলন গণমাধ্যমে ধরা পড়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক। মূল বা প্রকৃত কারণগুলো দূরীভূত না করে গায়ের জোরে সম্মান আদায় করাটা নিতান্তই বোকামির কাজ। সম্মান আইন করে লাভ করা যায় না। এটি লাভ করতে হয় মানবসেবা করে, দেশসেবা করে, মানুষকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে। সৎ, খোদাভীরু, মানবদরদি ও আদর্শবানদের মানুষ আপনা-আপনিই মন থেকে শ্রদ্ধা করে, কোন আইন লাগে না।
শেষে এটাই বলব, এ দেশ ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার। আমরা চাই, সবাই তার নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। এক্ষেত্রে যারা বিরোধ সৃষ্টি করতে চাইবে তাদেরকে কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা যারা ধর্মের নামে অধর্ম করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। কেননা ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের সঙ্গে যে দেশই সুসম্পর্ক বজায় রাখবে সে দেশে কখনো শান্তি ফিরে আসতে পারে না, পাকিস্তান এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
[লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট ]
abu.afia2016@gmail.com
 
                                 
			 
    	 
                                 
                                

