বয়স্কদের একাকিত্ব ঘুচাতে হবে আমাদেরই

সালাহ্ উদ্দিন নাগরী : গত মাসে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ী নিজ বাসায় মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিন/চার বছর ধরে ওই ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকতেন। তার স্ত্রী ও ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় এবং মেয়ে স্বামীসহ বনানীতে থাকেন। ফেসবুক লাইভে তিনি বলেন-বাবারা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে, পরিবারকে সবকিছু দেওয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু পরিবার অনেক সময় অনেক কিছু বুঝতে চায় না। হ্যাঁ, প্রায় সব সমাজ, রাষ্ট্রে হত্যা, আত্মহত্যার ঘটনা নিয়মিত ঘটে থাকে। আমাদের এখানেও ঘটছে; কিন্তু এ ঘটনাটি একটু যেন বেশিই চর্চিত হয়েছে। বহু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আসছে-কেন তিনি এভাবে আত্মহত্যা করলেন, তাও আবার ফেসবুক লাইভে এসে। ঘটনা পর্যালোচনায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বলছে-নিকটাত্মীয়দের প্রতি অভিমান, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনদের আর্থিক প্রতারণা, ব্যক্তিজীবনে হতাশা, বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা এ আত্মহননের কারণ হতে পারে। আর এসব কিছুতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার আগ্রহই হয়তো তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, পাশে দাঁড়াবে, অন্যের সমস্যা সমাধানে হাত বাড়িয়ে দেবে-এ বিষয়গুলো মনেপ্রাণে সবাই চায়। কিন্তু যখন এ চাওয়া-পাওয়ার হিসাব গোলমেলে হয়ে যায়, তখন অনেকের কাছে বেঁচে থাকাটাই বৃথা ও মূল্যহীন মনে হয়। প্রয়োজনের মুহূর্তে যখন পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাওয়া যায় না, তখনই হয়তো আত্মহত্যা করে। আর আলোচ্য এ আত্মহত্যার পেছনে এ কারণগুলোই অনেকাংশে মুখ্য হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই তো গত বছরের এপ্রিলে বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষক ড. তারেক শামসুর রেহমানের মৃত্যু হলে বাসার দরজা ভেঙে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার মৃতদেহ বাথরুমের দরজার কাছে কাত হয়ে পড়েছিল। তিনিও দুবছর ধরে তার ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা বিদেশে বসবাস করছেন।

মানুষ একা বাঁচতে পারে না; কিন্তু তারপরও যদি কাউকে পরিবার ও সমাজ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয় বা থাকতে বাধ্য করা হয়, তাহলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তো ঘটবেই। সারা জীবন স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য পরিবেষ্টিত একজন মানুষের পক্ষে তো শেষ বয়সে একাকী থাকা সম্ভব নয়; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বয়স্ক ব্যক্তিরা নিয়ত একা হয়ে যাচ্ছেন এবং এ হার ক্রম ঊর্ধ্বমুখী। যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি, বিদেশে স্থায়ী বসবাসের ছাড়পত্র পাওয়ার কোশেশ, স্বামী/স্ত্রীর মৃত্যু, মা-বাবার প্রতি সন্তানসন্ততির দায়িত্বে উদাসীনতা ও পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতাকে বিদগ্ধজনরা এজন্য দায়ী করছেন।

এসব মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ সরব। মৃত্যুগুলোয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ভূমিকা, দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ হচ্ছে, বহু ধরনের আলোচনা এবং মতামত দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ও ভাই-বোনের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত। আসলেই ভবিষ্যতে যেন এরকম আর না ঘটে, তাই এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিবার, সমাজকে সে আদলে সাজাতে হবে। করণীয়গুলো আগে থেকেই নির্ধারণ করে নিতে হবে।

আমাদের সমাজে সাধারণত দ্বিতীয় বা একাধিক বিয়েকে কখনই সহজ, স্বাভাবিক ও যৌক্তিকভাবে বিবেচনায় আনা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে কেউ বিয়ের কথা বললেই তাকে নিন্দা, কটুকথা ও গালমন্দের মুখোমুখি হতে হয়। তৎপ্রেক্ষিতে একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে-রাজশাহীতে বসবাসরত আমার এক আত্মীয়ের স্ত্রী মারা যাওয়ার দুবছর প্রায় হয়ে গেল। ভদ্রলোক সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন বছর তিনেক আগে। তিন সন্তানের একজন তার সঙ্গে থাকেন, অন্য দুজন রাজশাহীর বাইরে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত। সংগত কারণে ওরা তাকে সময় দিতে পারেন না। তার সময় কাটে না, কথা বলার সঙ্গী নেই। বিষণ্নতা, বিমর্ষতা কমানোর জন্য সন্তানদের কাছে তিনি পুনরায় বিয়ের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। সন্তানরা পিতার এ বিয়েতে কোনোভাবেই মত দিচ্ছেন না, আবার পিতার দুর্দশা লাঘবেও এগিয়ে আসছেন না।

অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে দ্বিতীয় বিয়েকে গোঁড়া ও মোল্লাদের কাজ বলে অপবাদ দেওয়া হয়। কিন্তু লিভ টুগেদার, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, পরকীয়াকে ওই ধরনের তির্যক দৃষ্টিতে দেখা হয় না। কী বিচিত্র আমাদের ধ্যানধারণা! তাই দ্বিতীয় বিয়ে বা একাধিক বিয়ের বৈধ কারণ বিদ্যমান থাকার পরও অনেকেই দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলতেই পারে না। আর এ কারণে গোপনে, আড়ালে-আবডালে অনৈতিক কাজের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। আর ক্ষণিকের মোহ শেষে দেখে তার পাশে কেউ নেই, আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। তাই আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার দোহাই দিয়ে কেউ যেন বিচ্যুতির পথে না যায়, সে ব্যাপারে সুধী মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।

কিছুদিন আগে কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির পাঁচবারের সভাপতি (সাবেক) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইসমাইল ৯০ বছর বয়সে বিয়ে করে দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছেন। প্রায় সাত বছর আগে তার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে একাকিত্ব নিরসনে মিনু আরা নামে ৪০-৪৫ বছর বয়সের এ কনেকে তিনি বিয়ে করলেন। বিয়ের এ অনুষ্ঠানে অ্যাডভোকেট সাহেবের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা উপস্থিত ছিলেন। এ খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনরা নবদম্পতিকে শুভকামনা জানিয়েছেন। তারা পরস্পরকে সময় দেবেন, হাসি-খুশিতে দিন পার করবেন, তবেই এ বিয়ে সার্থক ও মধুময় হবে।

আমাদের অনেকেই নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে স্থায়ী করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন। তাদের বিদেশে পাঠিয়ে নিজে বছরের পর বছর দেশে একা বসবাস করছেন। বিচ্ছিন্ন এ পরিস্থিতিতে পারিবারিক সম্পর্ক বিঘ্নিত হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আলগা হচ্ছে। এতে পরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তারপরও আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে হচ্ছে, ব্যক্তি-পরিবার ও সংসারের শান্তি অপেক্ষা ‘পারমানেন্ট রেসিডেন্সি’র জন্য সবকিছু ছেড়ে বিদেশে অবস্থান করাই জরুরি হয়ে পড়ছে। আর এটি তো অনেক পরিবারের কাছে রীতিমতো ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সুখপাখি বাঁধন ছিঁড়ে পারিবারিক বন্ধনকেই নষ্ট করে দিচ্ছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ‘লাইভে এসে আত্মহত্যা’ ও অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলো দুদেশে বসবাসকারী স্বামী-স্ত্রীদের জন্য একটি সতর্ক ও জরুরি বার্তা।

আমরা সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাচ্ছি। পরবর্তীকালে তার দেখভালের জন্য ‘মা’ যাচ্ছেন, বাবা থাকছেন দেশে। ফলে স্বামী-স্ত্রীকে বছরের পর বছর আলাদা আলাদা থাকতে হচ্ছে। হয়তো আর কোনোদিনই একত্রিত হওয়া যাচ্ছে না। আমাদের পারিবারিক বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সচ্ছল ও সক্ষম সন্তানরাও বৃদ্ধ মা-বাবার দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। পরিবার, সন্তানের অবহেলায় আজ বৃদ্ধ মা-বাবার ঠিকানা হচ্ছে পুনর্বাসন কেন্দ্র। তাই তো ইউরোপ, আমেরিকার মতো আমাদের দেশেও বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের চাহিদা বেড়ে চলেছে। সন্তান-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ আজ বড়ই একা। লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষোভে তারা নিজেদের সমাজ থেকে আড়াল করে নিচ্ছেন। আগারগাঁওয়ের প্রবীণহিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমের ৮৭ বছরের এক বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘সন্তানদের জন্য মনের মতো সুন্দর আর বিখ্যাত ব্র্যান্ডের একজোড়া জুতা কিনতে ১০/১২ দিন ধরে বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরেছি। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন একেবারেই নিঃস্ব, বড়ই একা। বৃদ্ধাশ্রম কবরের মতোই। আর্তনাদ করি, দ্রুত মৃত্যু হলেই বেঁচে যাই।’ সভ্য এ সমাজের সন্তানদের জন্য এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে?

শুধুই কি বৃদ্ধাশ্রম? সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বসবাস করা বৃদ্ধরা সবাই যে মানসিকভাবে ভালো আছেন, তাও নয়। বৃদ্ধ মা-বাবার অনেককে অযত্ন-অবহেলায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। বাসার সবচেয়ে অন্ধকার, স্যাঁতসেতে কোনো ঘর বা বারান্দার এক চিলতে অংশ পার্টিশান দিয়ে তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘদিন চার দেওয়ালের মধ্যে কাটানোর প্রভাব পড়ছে বয়স্ক মানুষদের ওপর। তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন, অসহায়ত্ব তাদের ওপর জেঁকে বসছে। পরবাসীর মতো অনেকটা একাকী জীবন পার করছেন। শেষ বয়সে যখন প্রিয়জনদের নিয়ে সময় কাটানোর কথা, তখন নিঃসঙ্গতা তাদের গ্রাস করছে। একা একা জীবনযাপন করতে করতে অনেকেই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।

অবসরে চলে গেলে বা বয়সের নির্ধারিত স্তরে পৌঁছে গেলেই মানুষের সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। অনেকেই এখনো সমাজে অবদান রাখার মতো অবস্থায় আছেন। তাদের যার যে বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে, তা কাজে লাগাতে হবে। সমাজ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এভাবে ফেলে রাখলে আমাদেরই ক্ষতি। তাদের সেবামূলক কাজে জড়িত করতে হবে, সামাজিক সমস্যা নিরসনে সম্পৃক্ত করতে হবে। এতে তাদের যেমন সুন্দর সময় কাটবে, একইভাবে সমাজও লাভবান হতে পারবে।

বয়স্কদের প্রতি দায়িত্ব পালনে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানকে। বিদেশে স্থায়ী হওয়ার বাসনায় বা স্বামী-স্ত্রীর যথাযথ বনিবনা না থাকার দোহাই দিয়ে পরস্পর আলাদা বসবাস কিন্তু নিত্যনতুন ঝামেলাই তৈরি করে। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনকে পরস্পরের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। বয়স্করা যেন তাদের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ও উঠাবসা করতে পারে, সে সুযোগ সৃষ্টির ভার আমাদেরই নিতে হবে। করোনাকে অসিলা হিসাবে অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া, তাদের সঙ্গে উঠাবসা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছেন, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না। বৃদ্ধ স্বজনদের জন্য পরিবার, বৃহত্তর পরিবার ও সমাজে আনন্দময় ও সুখকর পরিবেশ তৈরি এবং তা বজায় রাখতে সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী

Exit mobile version