ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরীক্ষিত লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলা সদরের পূর্বদীপেশ্বর গ্রামের শামসুদ্দিন সামু। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সম্মান পান তিনি।
কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, উপজেলা ও জেলা থেকে বারবার তার সপক্ষে প্রতিবেদন গেলেও মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে না পারায় ওপর মহলের লাল ফিতায় আটকা পড়ে তার স্বীকৃতি, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা। আর এ কারণে চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে বিনাচিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলা সদরের পূর্বদীপেশ্বর গ্রামের শামসুদ্দিন সামু। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তার এক ভাই দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে শহিদ হন। এ ঘটনার পর পালিয়ে ভারতে গিয়ে অম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টার থেকে তার সহোদর অন্য তিন ভাইয়ের সঙ্গে ট্রেনিং নিয়ে ১১নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এক হাতে রাইফেল অন্য হাতে জীবন নিয়ে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অসংখ্য সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ কারণে এলাকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম কাতারে বরাবরই নাম ও অবস্থান ছিল তার। বারবার যাচাই-বাছাইয়ে প্রথম সারিতে নামও গেছে তার।
আরও জানা যায়, মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে না পারায় ওপর মহলের লাল ফিতায় বরাবরই আটকা পড়ে স্বীকৃতি। ৯ ছেলেমেয়ের সংসার চালাতে গিয়ে রিকশার হ্যান্ডেল ধরে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন তিনি। ঢাকায় অবস্থান করে ২০১৮ সালের দিকে মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে আবেদন নিয়ে সাক্ষাৎও করেন তিনি। তিনি আশ্বাসও দিয়েছিলেন তাকে। অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন তার আবেদনপত্রে। কিন্তু তাতেও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ফাইলের লাল ফিতার গিট খোলেনি।
আরও জানা যায়, অবশেষে বার্ধক্যজনিত ব্যাধিতে দীর্ঘদিন বিনাচিকিৎসায় শয্যাশায়ী থেকে তিন বছর আগে জীবনের কাছে হার মানেন মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয়ী বীর। মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনও করে তাকে।
কিন্তু হার মানেননি, তার দ্বিতীয় মেয়ে মঞ্জিলা আক্তার। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে পিতার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামে নেমে স্বামী সংসার হারিয়েও আজও হার না মানা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। পিতার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিসহ অন্যান্য ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য তিনি মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়েও উপজেলা ও জেলা প্রশাসন থেকে নাম যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন সামুর। মঞ্জিলা আক্তারের অভিযোগ পাঁচ লাখ টাকা দিতে না পারায় ওই ‘ক’ তালিকায় ৯নং ক্রমিকে থাকা তার বাবার নামের স্থলে পরে রহস্যজনকভাবে অন্য ব্যক্তির নাম এসে যায়।
হোসেনপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন জানান, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন সামু তারই সঙ্গে ভারতের অম্বিনগরে ট্রেনিং নিয়ে ১১নং সেক্টরের অধীন যুদ্ধ করেছেন। এমনকি কিশোরগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে প্যারাভাঙ্গার ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এমন ঘটনাকে নিষ্ঠুর পরিহাস এবং জাতির জন্য লজ্জ্বার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ ব্যাপারে কথা হলে হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাবেয়া পারভেজ বলেন, মৃত্যুর পর তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সম্মান পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সব ধরনের সার্টিফিকেট— এমনকি উপজেলা প্রশাসন থেকে পজিটিভ রিপোর্ট যাওয়ার পরও কীভাবে জামুকা থেকে তার নাম বাদ পড়ে, তা বলতে পারলাম না। তবে জামুকা থেকে কোনো প্রতিবেদন চাইলে কিংবা ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লেখালেখি করতে পারেন বলে জানিয়েছেন।