মূর্তি বনাম ভাস্কর্য
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশে মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে চলমান বিতর্কে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্য নিয়ে। কোরআনে মূর্তি পরিহারের নির্দেশনা রয়েছে, কারণ মূর্তি মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। হাদিস অনুযায়ীও কোন প্রাণীর ছবি অঙ্কন করলে পরকালে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিছু আলেম মনে করেন মূর্তি আর ভাস্কর্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা আরও উল্লেখ করেন, পূজার উদ্দেশ্য থাকুক বা নাই থাকুক কোন প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ বা স্থাপন করা শরিয়তসম্মত নয়। অন্যদিকে বিপক্ষের অভিমত হচ্ছে, কোরআনে মূর্তি বলতে শুধু পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত অবয়বকে বোঝানো হয়েছে। তাদের আরও অভিমত হচ্ছে, মূর্তি আর ভাস্কর্য এক হলে নবীজীর পর মুসলমান শাসকদের অধিকৃত দেশসমূহের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হতো, কিন্তু খেলাফত ও সাহাবিদের অভিযানে অধিকৃত কোন ভূখন্ডে সেখানকার ভাস্কর্য বা মূর্তি ভাঙার উল্লেখযোগ্য কোন নজির পাওয়া যায় না।
হাদিসে প্রাণীর ছবির ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে বিধায় প্রাণী ব্যতীত অন্য যে কোন গাছ, লতা-পাতা, নদী-সাগর, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলসহ বিভিন্ন বস্তুর ছবি, ভাস্কর্য, মূর্তি ইত্যাদি অঙ্কন, নির্মাণ, স্থাপন ও প্রদর্শন করা যাবে বলে অনেক আলেম অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এই অভিমতের অসারত্ব প্রমাণিত হয়ে যায় আশ্চার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিষ্কারের পর- তিনি বলেন ‘গাছেরও প্রাণ আছে’। আবার আরেকটি বুখারি হাদিস অনুযায়ী আল্লাহর সৃষ্ট প্রাণী-জড় নির্বিশেষে কোন কিছুরই প্রতিকৃতি করা যাবে না; কারণ মানুষের পক্ষে একটি কণা, একটি শষ্য কিংবা একটি যবও সৃজন করা সম্ভব নয়। কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আজাবে ওই সব লোক পতিত হবে যারা আল্লাহর সৃষ্টির কোন প্রতিকৃতি তৈরি করে। প্রাণীসহ প্রকৃতি জগতের সব কিছুই আল্লাহর সৃষ্টি; এই নির্দেশানুযায়ী গাছপালারও ছবি তোলা বা অঙ্কন করা যাবে না। কোন কোন আলেমের মতে ক্যামেরায় ছবি তোলা জায়েজ, কিন্তু সেই ছবি হাতে অঙ্কন করা যাবে না। এই মতের সঙ্গে অনেক আলেম একমত নন, বিশেষ করে দেওবন্দের আলেমদের মতে, পেইন্টিং ও ডিজিটাল ছবি উভয়ই হারাম; কারণ প্রাণীর ছবি হারাম হলে তা যেভাবেই তৈরি করা হোক না কেন তা হারামই। এই হিসেবে মানুষের ছবি তোলা হারাম। পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলা অপরিহার্য বলে আটরশির পীর নাকি হজে যাননি। ক্যামেরায় ছবি তোলা নিয়ে মতভেদ থাকলেও অঙ্কন করা যে নাজায়েজ সে ব্যাপারে সব আলেম একমত। আঁকা প্রাণীর ছবি হারাম হলে প্রায় সব মুসলিম দেশের ব্যাংকনোট ও ধাতব মুদ্রা ব্যবহারের অনুপযুক্ত। কারণ প্রত্যেকটি দেশের ধাতব মুদ্রা ও কাগজের নোটে রাজা, বাদশাহ, জাতির পিতা, বিখ্যাত ব্যক্তি বা গাছ-পালার ছবি রয়েছে, এই ছবিগুলো ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা ছবি নয়- এই ছবিগুলো ভাস্কর্যের মতো খোদাই বা অঙ্কনের মাধ্যমে তৈরি হয়। ভাস্কর্যও খোদাই বিদ্যা।

পৃথিবীর মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করেন ইন্দোনেশিয়ায়। হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাহন গরু ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক। ইন্দোনেশিয়ার বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে জুড়ে দেব-দেবীর ম্যুরাল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে অসংখ্য ভাস্কর্য। ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের নাম মেঘবতী, সুকর্ত, সুহার্তো। ইন্দোনেশিয়ার এককালের প্রেসিডেন্ট মেঘবতী সুকর্তপুত্রী একজন সাচ্চা মুসলমান। হিন্দু পুরাণের একটি চরিত্রের নাম সুকর্ত। এই সুকর্ত ছিলেন মেঘবতীর বাবা, এককালের ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তাদের জাতীয় গ্রন্থ হিন্দুদের রামায়ণ। তাদের টাকা বা ব্যাংকনোটের মধ্যে হিন্দু দেবতা গণেশের মূর্তি। পর্যটন দ্বীপ বালিতে নানা দেবদেবীর মূর্তি- কোনটা পুরুষের, কোনটা নারীর; কেউ নৃত্যরত, কেউ যুদ্ধরত; কোনটার হাতে তীর-ধনুক, কোনটার হাতে বংশী। সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ বহু বছর পূর্বে একবার ইন্দোনেশিয়া সফরে গিয়েছিলেন, তার সম্মানে ভাস্কর্যগুলো ঢেকে দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, কিন্তু বালির স্থানীয় সরকার তাতে রাজি হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারকে তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল যে, ভাস্কর্য ও মূর্তিগুলো যেমন আছে তেমনই থাকবে; কারণ এগুলো তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিচয় বহন করে। ইন্দোনেশিয়ায় অতি সম্প্রতি আবার বারাক ওবামার শৈশবের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।
শুধু ইন্দোনেশিয়ায় নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জাতীয় হিরোদের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়ে থাকে তাদের স্মরণীয় করে রাখার জন্য, পূজা করার জন্য নয়। এই বিবেচনায় প্রায় সবগুলো মুসলিম অধ্যুষিত দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্য দেখে কেউ মুশরিক হয়েছে বলে জানা যায় না। সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখতে অহর্নিশ দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে থাকে; এই দেশগুলোতেও অসংখ্য ভাস্কর্য ও ভাস্কর্যের মিউজিয়াম রয়েছে। আয়াতুল্লা বেহেস্তিসহ অনেক খোমেনির ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে। মানুষের ভাস্কর্য আছে কিরগিজস্তান, কুয়েত, কাতার ও দুবাইয়ে। ৮৯% সুন্নি মুসলমানের দেশ তুর্কমেনিস্তানে সোনা দিয়ে বাঁধানো একটি বিরাট কুকুরের স্ট্যাচু রয়েছে। শিখ মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের স্ট্যাচু রয়েছে লাহোরে। আলবেরুনি, ইবনে বতুতা, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বেনজীর ভুট্টো, কামাল আতাতুর্ক, রফিক হারিরি, খোমেনি, জিয়াউর রহমান- এমন আরও শত শত ব্যক্তির ভাস্কর্য মুসলিম দেশসমূহে রয়েছে। পারস্যের কবি শেখ সাদীর নাত ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি, কাশাফাদ্দুজা বি জামালিহি’ ছাড়া আমাদের দেশে কোন মিলাদ হয়েছে বলে মনে হয় না, শেখ সাদীর মাজারের সামনেই তার একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য রয়েছে। সুফিসাধক জালালুদ্দীন রুমির আবক্ষ মূর্তি রয়েছে ইরানে। মিসরে প্রাক-ইসলাম যুগের মূর্তি পূজকদের স্ফিংস আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া পরবর্তী মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে ফেরাউনের মমিকে বিনষ্ট হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখার কথা কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। সুরা মায়েদার ১১০ নম্বর আয়াতে ঈশা (আ.) কর্তৃক মাটি দিয়ে পাখির প্রতিকৃতি তৈরি করে আল্লাহর হুকুমে তাতে ফু দিয়ে জীবিত পাখি করার কথা উল্লেখ রয়েছে। স্ত্রী আয়েশার (রা.) ঘোড়ার পুতুলের ডানা দেখে নবী মুহাম্মদ (সা.) হেসে উঠেছিলেন, প্রাণীর পুতুল নিয়ে খেলতে নিষেধ করেনি। মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশে কাবাঘরের ৩৬০টি মূর্তি ধ্বংস করা হয় এবং হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবি ব্যতীত অপরাপর সব ছবি মুছে ফেলা হয়েছিল (সিরাত- ইবনে হিশাম ইবনে ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ৫৫২)। আল আজহারের গ্র্যান্ড শায়েখ জাদুল হক, প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মদ ইমারাহ, ইউরোপিয়ান ফতোয়া কাউন্সিলের শেখ ফয়সালসহ অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্ব ভাস্কর্য ও ছবির পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। এদের অভিমত হচ্ছে, ভাস্কর্য নিয়ে কেউ উপাসনা করে না, উপাসনার উদ্দেশ্যে কিছু আঁকা বা ভাস্কর্য তৈরি করা যাবে না।
বাংলাদেশে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও দেশ তো ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ নয়, শরিয়াহ আইনও আমাদের দেশে নেই; শরিয়াহ আইন অনুসৃত বিভিন্ন ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক দেশেও ভাস্কর্য কেন আছে তা স্পষ্ট নয়। মাওলানা মামুনুল হক টকশোতে বলেছেন, মুসলমানের জীবনাচার চলবে কোরআন সুন্নাহ দিয়ে; কোন দেশের উদাহরণ দিয়ে নয়। মামুনুল হক সাহেবের কথার যুক্তি আছে, কিন্তু ধর্মের এমন একটি বেসিক নির্দেশনা ৫৬টি মুসলিম দেশ কেন মানছে না তা নিয়েও আলোচনা-পর্যালোচনা বা গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি আবার তুরস্ক ঘোষণা দিয়েছে, কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য আমাদের দেশে এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তাদের দেশে হবে।
বঙ্গবন্ধুর আমলে ধর্মকে এভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিপক্ষ করে দাঁড় করানো যায়নি। পাকিস্তানি সেনাদের অপকর্মে সহায়তা দেয়ার কারণে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র তৈরির পদক্ষেপকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা তখন কোন ইসলামপন্থি দলের ছিল না। আস্তে আস্তে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের অপকর্ম ঢাকা পড়তে থাকায় ইসলামপন্থি দলগুলো শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এখন ভাস্কর্য টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। সম পর্যায়ের অপরাধ ধর্ষণ, বলাৎকার, ঘুষ, দুর্নীতি, সুদ বন্ধের জন্য আলেমগণ এভাবে সোচ্চার হলে দেশের চেহারাই বদলে যেত। সোচ্চার হচ্ছেন না বলেই অনেকেই মনে করছেন, মাদরাসার ধর্ষণ ও বলাৎকারের মহামারি ঢাকা দেয়ার জন্য এই সময়ে ভাস্কর্যের ইস্যু তৈরি করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে রাজনীতির ইস্যুও থাকতে পারে। ভেতরে যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারের পক্ষে উদ্ভুত পরিস্থিতি হজম করা যেমন কঠিন, বমি করাও সহজ নয়।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com



