মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকার প্রবাহে লাগাম

দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহে লাগাম টানা হবে। তবে উৎপাদন খাতে টাকার জোগান বাড়ানো হবে।

অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্যে ঋণের প্রবাহ হ্রাস করা হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখতে কমানো হবে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ।

এজন্য অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। এসব লক্ষ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আজ আগামী অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে।

এদিকে আসন্ন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে চিহ্নিত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনার পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শেষ না হতেই আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যায় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। এসব কারণেও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব প্রলম্বিত হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতির হারে রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশেও এই হার বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশ মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এতে ব্যবসা বাণিজ্যের কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে। মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের একটি সহজ পদ্ধতি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই পথে যাচ্ছে না। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী খাতে টাকার প্রবাহ কমিয়ে উৎপাদনমুখী খাতে বাড়ানো হবে। একে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান বাড়ানো হবে বা সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় গত দুই অর্থবছর ধরে সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় এবার সম্প্রসারমুখিতে যাচ্ছে না। কিছুটা লাগাম টানা হচ্ছে।

নতুন মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এজন্য যা যা করা দরকার তাই করেছি। মুদ্রানীতিতে কোনো চমক আছে কি না জানতে চাইলে প্রধান এ অর্থনীতিবিদ বলেন, নতুন কোনো চমক আপাতত নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বড় লক্ষ্য। পাশাপাশি কাক্সিক্ষত জিডিপি অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টি নজর দিয়েছি।

চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) শেষ দিন আজ। আগামীকাল থেকে নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু। ওই দিন থেকেই মুদ্রানীতি কার্যকর হবে। তবে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে রোববার থেকেই মুদ্রানীতি কাজ করবে। প্রতি বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজেট পাশ হলে জুলাইয়ের শেষ দিকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এবার আগে করছে। কেননা, আগামী ৩ জুলাই রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের শেষ কার্যদিবস। তিনি বিদায় নেওয়ার আগে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে যাচ্ছেন।

আগে সাধারণত সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মুদ্রানীতি ঘোষণা করতেন। কিন্তু করোনার কারণে গত দুই বছর আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আগে প্রতি ছয় মাসের আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেও গত দুই অর্থবছর তা এক বছরের জন্য করা হয়। তবে এবারের মুদ্রানীতি অনলাইনের পরিবর্তে সরাসরি ঘোষণা করবেন গভর্নর ফজলে কবির।

নতুন অর্থবছরে গ্যাস, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির আরও চাপ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স কমা ও রপ্তানি আয় কমার আশঙ্কাও রয়েছে। এতে বিনিময় হারেও চাপ বাড়াতে পারে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে, যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত এপ্রিল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি মিলে জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ১৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, এপ্রিল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

এদিকে দিন দিন বাড়ছে ডলারের দাম। ফলে ডলারের বিপরীতে পতন হচ্ছে টাকার মান। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত ৯ টাকা ৪৫ পয়সা বেড়েছে ডলারের দাম। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এটি রেকর্ড। এ কারণে টাকার মান ধরে রাখাতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

জানা গেছে, গভর্নর হিসাবে ফজলে কবিরের মেয়াদ আগামী ৩ জুলাই শেষ হবে। ইতোমধ্যে নতুন গভর্নর হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। আগামী ৪ জুলাই নতুন গভর্নর হিসাবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দাপ্তরিক প্রয়োজনে তিনি ১২ জুলাই গভর্নর হিসাবে যোগ দেবেন।

Exit mobile version