আনিকা মাহজাবিন
সন্ধান২৪.কম ডেস্ক : গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে যান শেখ হাসিনা। এর আগে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে পুলিশ ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলায় অনেক আন্দোলনকারী হতাহত হয়েছেন। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। একই সঙ্গে উঠছে গণহত্যা ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে অভিযুক্তদের রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবিও।
বিষয়টি বিবেচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ও। সম্প্রতি ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ আইনের সংশোধনবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আটটি সংশোধনীর প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে অষ্টম সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে, সেক্ষেত্রে দলটিকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হবে।
৬৫ বছর আগেও দেশে (তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাংশ) অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর ছিল এমন দুটি আইন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান। পরদিনই এক আদেশ জারির মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তিনি। পরে এ নিয়ে দুটি অধ্যাদেশও জারি করা হয়। এর একটি হলো পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার (পোডো)। অন্যটি হলো ইলেকটিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার (এবডো)।
এ দুই আদেশবলে দেশের যেকোনো সরকারি পদে আসীন এবং যেকোনো নির্বাচিত সংস্থার সদস্যকে অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত করার ক্ষমতা পায় তৎকালীন সামরিক সরকার। গঠন করা হয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। অসদাচরণ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ এবডো ও পোডো অধ্যাদেশের কারণে সে সময় অনেক রাজনীতিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়।
অনেকেই সে সময় রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হয়ে যান। এ দুই অধ্যাদেশের ভিত্তিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও খান আবদুল গাফফার খানসহ (সীমান্ত গান্ধী) একশর কাছাকাছি শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, ফরেন সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস এবং প্রাদেশিক সার্ভিসের হাজারের অধিক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এবডো ও পোডোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
দেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংস্কারে সরকারের নিযুক্তরা মনে করছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় যেকোনো পদক্ষেপই এখন নেয়া যেতে পারে। জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে যারা ধ্বংস করেছে, তারা আমাদের সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছে। সংবিধানের কয়েকটি মৌলিক কাঠামোর অন্যতম হলো গণতন্ত্র। এগুলো অলঙ্ঘনীয়। সংবিধান লঙ্ঘনের মধ্য দিয়েই ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তারা একতরফা ও পাতানো নির্বাচন করেছে। যদিও নির্বাচন কমিশনগুলো বলার চেষ্টা করেছে, তাদের দায়িত্ব হলো শুধু নির্বাচন করা। কিন্তু সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে এবং এ কমিশনের সদস্যদের পদচ্যুতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। তাদের অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশন তাদের এ ক্ষমতা ব্যবহার করেনি। সাংবিধানিক দায়িত্বও পালন করেনি। বরং তাদের সময় এমন নির্বাচন হয়েছে, যা এ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। অতএব তাদেরকে আমি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের খলনায়ক বলে মনে করি। তাদের বিচারের আওতায় আনার বিষয়টি গভীরভাবে ভাবা দরকার, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের অপরাধ না করে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকার রাষ্ট্রের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ক্ষমতাসীনদের পছন্দসই ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বসিয়েছিল। তারা নানাভাবে শেখ হাসিনার সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছেন। যেখানে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার সুযোগ তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষ্যমতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা এবং বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য শেখ হাসিনা একের পর এক মামলা, জেল ও গুম করেছেন। সম্প্রতি তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত ১৫-১৬ বছরে বিএনপির ছয়শর বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে। হাজার হাজার লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। গায়েবি ও মিথ্যা মামলা। সুতরাং এ আন্দোলন তো আমরা প্রথম থেকেই করে আসছিলাম। আন্দোলনের জন্য কিছুদিন আগেও আমি জেলে গিয়েছি। আমাদের দলের নেতারা জেলে গেছেন, নিগৃহীত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পরদিন থেকেই গণহত্যার দায়ে প্রভাবশালী নেতাদের নামে মামলা দায়ের হতে থাকে। সেসব মামলায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দুই ডজনেরও বেশি মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা এবং শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সারা দেশে হাজারের অধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই দায়ের করা হয়েছে দুইশর বেশি মামলা। যেখানে ১৮১টিতে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিও এখন সামনে আসছে। আবার অনেকেই মনে করছেন, অপরাধী ব্যক্তিকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ না করে তাদের অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে শুধু দলকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির নাসির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দুটি বিষয়—একটি দল এবং অন্যটি ব্যক্তি। সুতরাং ব্যক্তি এবং দল—দুটিই বিচারের আওতায় আসা উচিত। দলটির অনেকেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাদেরকে আমরা শাস্তির আওতায় আনতে চাচ্ছি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হতে হবে। তবে আমি ব্যক্তিকে ঢালাওভাবে নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে। আমরা মনে করি যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার করা হোক। কিন্তু ব্যক্তিকে ঢালাওভাবে নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে আমরা। আর যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না তাদের ক্ষেত্রে রিডেম্পশন ও রিকনসিলিয়েশনের সুযোগ রাখা যেতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এর পাশাপাশি অনেকেই এ দলের ব্যানারকে ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে। তাই আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এ জায়গায় দায়বদ্ধ। বিচার প্রক্রিয়ায় বিচারকদের কাছে এ দলকে যদি নিষিদ্ধ করার মতো মনে হয় তাহলে নিষিদ্ধ করবেন। তবে নাগরিক কমিটি মনে করে আওয়ামী লীগ যেভাবে হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা এবং ২০-৩০ হাজারের অধিক মানুষকে আহত করেছে, সে জায়গায় আওয়ামী লীগের ব্যানারে দলীয় রাজনীতি হওয়া উচিত না। এটি একটি খুনি ব্যানার। এ ব্যানারে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের আসা উচিত না।’ বনিক বার্তা।