সন্ধান২৪.কম : বীর মুক্তিযোদ্ধারা তৃণমূল পর্যায়ে বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহ করবে । স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর শুরু হচ্ছে রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হবে ।
উপজেলা পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে, যাচাই-বাছাই করে তা জেলায় পাঠানো হবে। এই তথ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যাচাই-বাচাই করবে। আগামী বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আগে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে বলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধ কাউন্সিলের মহাপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম রুহেল সংবাদকে বলেন, রাজাকারদের তালিকা তৈরির জন্য ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কাজ করছে। এতদিন জামুকা আইনে রাজাকারদের তালিকা তৈরির বিধি ছিল না। তাই আইনটি সংশোধন করে জামুকা আইন-২০২০ খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়েছে। এরপর জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর আইনটি কার্যকর করা হবে। পরে কমিটি গঠনের মাধ্যমে রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হবে।
ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের বিধান সংযুক্ত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন-২০২০ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন- ২০২০ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। পরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাদের একটা তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল।’
মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ সমুন্নত রাখা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে ২০০২ সালে প্রণয়ন করা হয় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন। এই আইনে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রয়ণনের বিধান থাকলেও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের কোন বিধান ছিল না। তাই আইনগত ভিত্তি না থাকায় এতদিন রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আগে রাজাকারদের তালিকা করা ছিল আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু আইনগত কোন ভিত্তি ছিল না। গত ৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনের সংশোধন করে রাজাকারদের তালিকা করার বিষয়টি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। জাতীয় সংসদে আগামী অধিবেশনেই সংশোধিত ওই আইন পাস হয়ে যাবে। এই তালিকা করার সময় যাতে কারও প্রতি আক্রোশের বশবর্তী না হই, আবার বাড়তি আনুকূল্য দেখানোর জন্য কাউকে যেন বাদ দেয়া না হয়, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমরা যেন তৃণমূল থেকে এ তালিকা করতে পারি, আইন পাস করার পর সেভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করবে সরকার। পাশাপাশি তালিকা করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হবে।
যে প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ হবে রাজাকার তালিকা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের হত্যা, নির্যাতন ও অত্যাচার করেছে তাদের রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশিদের একটি অংশ পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছিল। অর্থনৈতিক কারণে হোক অথবা রাজনৈতিক কারণে হোক যারা পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছিল তাদেরকেই রাজাকার, আল-বদর ও আল শামস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরা স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের নিধন করার জন্য পাকিস্তানিদের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে তাদের রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করে রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহের কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান সংবাদকে বলেন, ‘জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ও মুজাহিদ বাহিনীর তালিকা সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন সদস্য (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি-এমএনএ) ও ৩০০ জন প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির মেম্বার বা গণপরিষদ সদস্য (এমপিএ) ছিলেন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৬৮ ও ১৮৩ জন বাদ দিয়ে বাকিদের তালিকা সংগ্রহ করা হবে। যাদের তৎকালীন পাকিস্তান সরকার মোনোনিত করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘এই তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রথমে দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা প্রশাসকদের। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম জেলা প্রশাসকদের পক্ষে এটা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কারণ অনেক জেলায় এই তথ্য সংগ্রহে নাই। পাকিস্তানিরা চলে যাবার সময় অনেক রাজাকারদের তালিকা তারা নষ্ট করে গেছে। সে কারণে জেলা পর্যায়ে সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া একটু কষ্টসাধ্য। পরবর্তীতে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম জেলা প্রশাসক দিয়ে নয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই বছর শেষদিকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদীয় কমিটির সদ্য সাবেক কমান্ডারদের আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় যুদ্ধকালে যারা কমান্ডার ছিল তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকা উপজেলা পর্যায় থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কাছে পাঠানো হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তালিকা যাচাই-বাছাই করে তা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।
শাজাহান খান বলেন, ইতোমধ্যে ১৪-১৫টি জেলার রাজাকারদের আংশিক তালিকা আমাদের হাতে পৌঁছেছে। এগুলো আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। এখনই আমরা এই তালিকা প্রকাশ করছি না। কারণ আমাদের একটি উদ্দেশ্য ছিল ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা এই তালিকা প্রকাশ করব। কিন্তু জাতীয় মুক্তিযুদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনে রাজাকারদের তালিকা তৈরির কোন বিধান ছিল না। কারণ ২০০২ সালে খালেদা জিয়া সরকার আমলে এই আইন তৈরি করা হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি বিধি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও রাজাকারদের তালিকা তৈরির বিধান যুক্ত করা হয় নি। তাই জামুকার মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ২০০২ আইন’ সংশোধন করার।
১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি
প্রায় এক দশক আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর রাজাকারের তালিকা তৈরির দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় গত বছর বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ তালিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য ওই তালিকা স্থগিত করা হয়। এ বছর জানুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে। খোদ সরকারি দলের সদস্যরাই এ নিয়ে মন্ত্রীর সমালোচনা করেন। সে সময় মন্ত্রী নতুন করে তালিকা তৈরির কথাও জানান। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি উপকমিটি ওই তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব তপন কান্তি ঘোষ সংবাদকে বলেন, ‘রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের কাজ একটি জটিল বিষয়। এর আগের ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ তালিকা প্রকাশ নিয়ে বিভিন্ন বির্তকের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই এবার স্বচ্ছভাবে যাতে এই তালিকা প্রণয়ন করা যায় সেজন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কাজ করছে। এছাড়া আইনগত ভিত্তির জন্য জামুকা আইন সংশোধন করা হচ্ছে।’