লড়াকু বাঙালির বিজয়গাথা ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
।। সাদেকুর রহমান ।।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর উপর্যুপরি হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই মাসের শুরু দিক থেকে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে পাকিস্তানবাহিনী হত্যা, ধ্বংসকা-, নির্যাতন বাড়িয়ে দিল আগের চাইতে বেশি পরিমাণে।
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বরের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠন। রণাঙ্গনে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারা। ভিন্নমাত্রা পায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় যৌথ কমান্ডের সম্মুখযুদ্ধ। বলা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানিদের দীর্ঘ দু’ যুগের শোষণ-বঞ্চনা, স্বার্থপরতা ও একচোখা নীতি থেকে মুক্তি পেতে বাঙালিদের মরণপণ যুদ্ধের প্রক্রিয়া একাত্তরের এদিন থেকেই শুরু হয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনী চারদিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। নবম ডিভিশন এগুতে থাকে গরিবপুর, জগন্নাথপুর হয়ে যশোর-ঢাকা হাইওয়ের দিকে। চতুর্থ ডিভিশন মেহেরপুরকে পাশকাটিয়ে এগিয়ে গেল ঝিনাইদহ-কালীগঞ্জের দিকে। বিংশতম ডিভিশন তার দায়িত্ব দু’ভাবে বিভক্ত করে নেয়। একটি অংশ থাকে হিলির পাক ঘাঁটি মোকাবিলার জন্য, আরেকটি অংশ হিলিকে উত্তরে রেখে এগিয়ে চলে সামনে। এভাবে নানা ডিভিশনে বিভক্ত হয়ে পাক হানাদার বাহিনীকে চারদিক থেকে কার্যত ঘেরাও করে ফেলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা।
‘চরমপত্র’ খ্যাত এম আর আখতার মুকুল তার ‘চল্লিশ থেকে একাত্তর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের বিমানবাহিনী হঠাৎ করে একযোগে ভারতের ছয়টি বিমান ঘাঁটিতে হামলা করলে দ্রুত যুদ্ধের ব্যাপ্তি লাভ করে এবং ঢাকার আকাশেও শুরু হয় বিমান যুদ্ধ।”
মফিদুল হক তার ‘জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয়’ শীর্ষক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, “৩ ডিসেম্বর ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতা অর্জন করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী এবং জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধে নিয়াজীর যুদ্ধ-পরিকল্পনা ছিল খুবই দুর্বল। পাকিস্তানিরা অস্থির হয়ে ছিল মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ভয়ে। কোন বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সংহতি আরও বাড়বে এবং প্রবাসে গঠিত বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত হয়ে উঠবে- এটা ছিল পাকিস্তানিদের আশঙ্কা। তাই তারা ছড়িয়েছিল গোটা সীমান্তজুড়ে। আর ছড়ানো-ছিটানো এসব পাকবাহিনীকে পাশকাটিয়ে তাদের বিচ্ছিন্ন করে এগোবার পন্থা অবলম্বন করেছিল ভারতীয় বাহিনী। বাংলাদেশ যুদ্ধের ময়দানে ‘বীরত্বের’ খেলাটি জমে ওঠলো ৩ ডিসেম্বরের পর থেকে। একে একে পাকবাহিনীর ঘাঁটিগুলোর পতন হতে থাকে এবং পশ্চাদপসারণরত পাকবাহিনী সাধারণ বাঙালিদের ঘৃণা ও প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে থাকে।”
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত তথ্যভা-ার থেকে প্রাপ্ত বর্ণনা মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে, উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তান চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ বলে চালিয়ে দিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা আদায় করতে।
এদিন বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে, ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনও আসছে।’ পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারতীয় ভূখ-ের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে। ভারতের উপর পাকিস্তান বাহিনীর এই হামলা পরিপ্রেক্ষিতে রাত সাড়ে ১১টায় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের উপর পাল্টা হামলা চালায়।
এদিন বিকেলে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাকালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের উল্লিখিত বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর মধ্যরাতের কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, ‘এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে।’ তিনি দেশবাসীকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান।
ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাবস্থা’ ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে। ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী সম্মিলিতভাবে পূর্ব সীমান্তে অভিযান শুরু করে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাক অবস্থানগুলোকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টায় সীমান্তের ৭টি এলাকা দিয়ে প্রচ- আক্রমণ পরিচালনা করে।
পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) এর সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়।
ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্টে বলেন, বাংলদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন বন্ধ করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ভারত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা কোন সুফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনে ও ভারত সীমান্তে পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে ভারতের নিরাপত্তা বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়েছে।
৪র্থ ও দশম বেঙ্গল ফেনী থেকে অগ্রসর হয়ে রেজুমিয়া সেতুতে উপস্থিত হয়। ১নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার বাহিনী নিয়ে অপর বাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়। ফেনী-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে এই যৌথবাহিনীর একটি কলাম ডান দিকে মুহুরি নদী ধরে এবং অপর কলাম বাঁ দিকে সড়ক ধরে চট্টগ্রামের দিকে এগুতে থাকে।
এদিকে এদিন বাংলাদেশে ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর একদল চৌকস বীর মুক্তিযোদ্ধা মধ্যরাত থেকে অ্যাকশন শুরু করে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাক ঘাঁটির ওপর বোমা বর্ষণ শুরু করে। এদের প্রধান লক্ষ্য ছিল অবশ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম। ঢাকা ছিল পাক বিমানবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এ ঘাঁটিতেই ছিল তাদের জঙ্গি বিমানগুলো।
রাত ৯টার দিকে একটি অটার বিমান নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুজন চৌকস অফিসারÑ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম (স্বাধীনতার পর দু’জনই সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) দুজন গানার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি সংরক্ষণাগারে একের পর এক রকেট নিক্ষেপ করে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দেয়। সাত ঘণ্টা সফল অভিযান চালিয়ে বিমান নিয়ে ভারতের কৈলা শহর বিমানবন্দরে ফিরে যায় তারা।
ঘন কুয়াশার মধ্যে উড্ডয়ন বিপজ্জনক হলেও দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম (স্বাধীনতার পর এই দুজনও সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) আরেকটি ‘অ্যালুয়েট’ যুদ্ধ বিমান নিয়ে চট্টগ্রামের জ্বালানি সংরক্ষণাগারে উপর্যুপরি বোমা বর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। অকস্মাৎ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীর সেনাদের হামলায় গোদনাইল ও চট্টগ্রামের ফুয়েল পাম্প ধ্বংস হয়ে গেলে মনোবলে চিড় ধরে উর্দুভাষী দখলদারদের।
এদিন তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যেকোন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিবে তারা।
এদিকে সংশ্লিষ্ট জেলা তথ্য বাতায়ন থেকে জানা যায়, অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা এদিন ভোররাতে উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তৎকালীন দিনাজপুর জেলার মহকুমা ঠাকুরগাঁও এবং দুপুর ১২টার দিকে উপকূলীয় জনপদ বরগুনাকে শত্রুমুক্ত করেন।
লেখক : সংবাদকর্মী ও মুক্ত গবেষক।
srahman5271@gmail.com.