লড়াকু বাঙালির বিজয়গাথা ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
সাদেকুর রহমান
ঊনিশশ’ একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর ছিল বুধবার, সময়ের পরিক্রমায় আজ মঙ্গলবার। বার বদলালেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতা, বীভৎসতা আজও বাঙালির হৃদয়ে দগদগে ঘা হয়ে আছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঊনপঞ্চাশ বছর আগেকার এই দিনে একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা ঘনীভূত হচ্ছিল, অন্যদিকে বিজয়ের চূড়ান্ত ক্ষণ নিকটবর্তী হচ্ছিল। এ দিন পাকবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে বিছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ঢাকার দিকে পালাবার কোন পথই হানাদার বাহিনীর সামনে খোলা ছিল না। একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেয়ারও কোন উপায় ছিল না। এই সুযোগে মিত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। জেনারেল জগজিৎ সিংকে অন্তত তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় বলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আর্কাইভ থেকে জানা যায়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত তথ্যপুঞ্জি থেকে আরও জানা যায়, তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীকে এই আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণ করলে পাকবাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। জেনারেল মানেকশ’র এই আহ্বান আকাশবানী থেকে নানা ভাষায় বারবার প্রচার করা হয়।
পূর্ব সীমান্ত থেকে জেনারেল সগৎ সিংয়ের প্রায় সবকটা বাহিনীই এখন দ্রুতগতিতে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি দল এগোচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে ঢাকার দিকে। অপর একটি বাহিনী আশুগঞ্জের সেতুর দিকে এগোচ্ছিল।
৫৭তম ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছায়। পাকবাহিনী এর আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে যায়। যুগপৎভাবে ‘এস’ ফোর্সও বিনা বাধায় সরাইলে পৌঁছায়।
সন্ধ্যার মধ্যে ১১শ’ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পূর্ব পাশে আজমপুর এবং দুর্গাপুরে সমাবেশ করে। সরাইল এবং শাহবাজপুরের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের দশম বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে সমবেত হয়। যৌথবাহিনীর এই অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্র দেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত।
এ দিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি পালন এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি শ্রী সমর সেন বলেন, ‘পাকিস্তানের অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।’
এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনী ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক রাজধানী করাচির নৌবন্দর আক্রমণ করে, যা ‘অপারেশন পাইথন’ নামে পরিচিত। যখন ভারতীয় সৈন্যবাহিনী এবং বিমানবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্থল সীমা অবরুদ্ধ করে রাখে তখন ভারতীয় নৌবাহিনী জলসীমা থেকে চাপ প্রয়োগ করার জন্য নৌযুদ্ধ শুরু করে। যেহেতু যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের নৌ-বন্দর অরক্ষিত তাই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনারা নৌবাহিনী ছাড়াই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যা ছিল অপ্রতিরোধ্য ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিরোধের একটি ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন নৌবাহিনী বন্দরে থাকার পরিকল্পনা করে।
প্রসঙ্গত, এর দিন চারেক আগে ভারতীয় নৌবাহিনী ‘অপারেশন ট্রাইডেন্ট’ পরিচালনা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেইবার প্রথম কোন নৌযুদ্ধে এন্টি শিফ মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছিল। ভারতীয় নৌবাহিনী আতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে করাচির নৌবন্দর ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেই বিজয়ের কথা মনে রেখে ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনী ‘নেভী ডে’ উদযাপন করে থাকে। এই অপারেশনের সাফল্যতার পিছনে ভারতীয় নৌবাহিনী ছাড়াও সদ্য প্রতিষ্ঠিত গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড এনালিসস উইং’ বা ‘র’ এর অবদান অনস্বীকার্য। ভারতীয় মিসাইলের আঘাতে করাচি বন্দরের তেলের ট্যাঙ্কে ব্যাপক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে যাতে শতাধিক পাকিস্তানি নাবিক নিহত হয় এবং ৫০০ জন আহত হয়। সেই আক্রমণে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কোমর ভেঙে দিয়েছিল ভারতীয় নৌবাহিনী।
এদিকে একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সর্বশেষ সামরিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে ভারতের সরকারি মুখপাত্র ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবে অন্য সব অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে, বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই কোন ভূখ- দখল করার অভিপ্রায় ভারতের নেই।’
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে এ দিনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করেন এভাবে- ‘ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এসএইচএফ মানেক্শ’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থা লক্ষ্য করে মনস্তাত্বিক যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তার ভাষণ বেতারে ঘন ঘন প্রচারিত হতে থাকে। তার বাণী প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিমানের সহায়তায় পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর বিলি করা হয়।’ মানেক্শ’ বলেন, ‘অস্ত্র সংরক্ষণ করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত। যৌথবাহিনী তোমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস, ওটা দিয়ে আর কোন সাহায্য পাবে না। বন্দরগুলোও এখন অবরুদ্ধ, তাই বাইরে থেকেও কোন সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা। মুক্তিবাহিনী এবং জনগণ এখন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত। তোমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সময় থাকতে অস্ত্র সংবরণ করলে তোমাদের সৈনিকদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে।’
বর্ণিত গ্রন্থে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ওদিকে কুমিল্লার পতন ঘটেছে। সব পাক সৈন্য ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছে। আরেকটি কলাম দাউদকান্দির দিকে। অপর একটি কলাম চাঁদপুরের দিকে। জামালপুর হালুয়াঘাটের দিকে আর একটি কলাম এগোলো। এদিকে বিমানবাহিনীর বিরামহীন আক্রমণ অব্যাহত রইল। পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ সেনাবাহিনী আর পাচ্ছে না। আর এ আক্রমণে তাদের মনোবলও ক্রমশ নিঃশেষিত হচ্ছে। আবার সাগর পাড়ি দিতে হয়। এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাস হলো। প্রস্তাবের উদ্যোক্তা মার্কিন সরকার। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়ে যাচ্ছিল। এবারও ফ্রান্স এবং ব্রিটেনসহ আটটি দেশ নীরব দর্শক। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য নয়। কাজেই এ ব্যাপারে ওদের কোন মাথা ব্যথাও ছিলো না। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের পূর্বেই বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে হবে।দৈনিক সংবাদ