শিক্ষকের অপমানে রাষ্ট্র অপমানিত হয়

আহসান হাবিব : শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করেছে এমন কোনো নজির নেই। বরং প্রাচীনকালের ইতিহাস থেকে আজ পর্যন্ত সেইসব দেশকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় যেসব দেশ শিক্ষায় উন্নত।

প্রাচীন রোমে শিক্ষা ব্যবস্থার শুধু উন্নয়নই ঘটেনি। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বড় বড় বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আজও যারা সর্বজন শ্রদ্ধেয়। প্রাচীন ভারতে গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা রীতি চালু ছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়টির কথা একবার একটু লক্ষ্য করুন। ৪২০-৩০ সালের দিকে যখন সারা পৃথিবীতে ধর্মশিক্ষা বা পারিবারিকভাবে শিক্ষালাভের বাইরে তেমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুই হয়নি, ঠিক সেই সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দশ হাজার ছাত্র ও ২০০০ শিক্ষক নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাধিক আলোচিত এবং চিত্তাকর্ষক ভবনটি ছিল এর লাইব্রেরি।

হাজার হাজার পবিত্র ও বিরল শাস্ত্রের জন্য গ্রন্থাগারটি নিজেই একটি বিশাল কমপ্লেক্স হিসাবে ব্যবহৃত হতো। একটি লাইব্রেরির ভবন নয়তলা উঁচু ছিল। ওই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, বৌদ্ধধর্ম, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, শরীরতত্ত্ব বিদ্যা, সংগীত, চিত্রকলা এসব বিষয় পড়ানো হতো।

পশ্চিমা বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার বহু বছর পরে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। কায়রোতে আল আজহার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭২ সালে, যা নালন্দার প্রতিষ্ঠার পায় সাড়ে পাঁচশো বছর পর। তার পর ইতালির বোলোনিয়া ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ সালে এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ১০৯৬ সালে অস্তিত্বলাভ করে, যা ১১৬৭ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ শুরু করে। বিখ্যাত কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি জš§ নেয় ১২৩১ সালে ও আমেরিকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১৬১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, নালন্দার শিক্ষা ছিলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা সবই ছিলো বিনামূল্যে। মূল ব্যয় বহন করতেন দেশের রাজা।

জনসাধারণও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সন্ন্যাসী ও ছাত্রদের জন্যে খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র ইত্যাদি দান করতেন। এখানে মূলত স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করা হতো। ভর্তি প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ। কারণ দেশি-বিদেশি বহু শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ছিল নালন্দায় পড়াশোনা করার। তার মানে শিক্ষা-দীক্ষায় আমাদের অতীত ইতিহাস ছোট নয় বরং অনেক বড়। আমাদের দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা কেমন ছিল সেটা পুরানো দলিল ঘাঁটলে দেখা যায়।

কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি আজকাল শিক্ষকের সম্মানের বিষয়ে এখন রূপকথা মাত্র। বিশেষত সাম্প্রতিক কালের একাধিক ঘটনা শিক্ষক- ছাত্র সম্পর্কের চিরায়ত শ্রদ্ধার বিষয়টির ওপর কুঠারাঘাত করেছে। মানুষ বিস্মিত হয়েছে- আহত হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর এ ধরনের আচরণকে কেউ মেনে নেয়নি।

নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা আর সাভারে ছাত্রের মারধরে শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে উদ্বেগ-প্রতিবাদের ঝড় বইছে। এর মধ্যেই সম্প্রতি শ্রেণিকক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের একজন অধ্যাপককে হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। কেন শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে- প্রশ্নটি জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে দেশজুড়ে। শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনার লাগাম টানতে তাগিদও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশিষ্টজনেরা এসব ঘটনায় সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাবকে দায়ী করছেন।

তারা বলছেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে পুরো সমাজেই অস্থিরতা বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষাঙ্গনে। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে মনে করেন তারা। বারবার শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনার নেপথ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং স্থানীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবকেও দায়ী করা হচ্ছে। নীরবে বেশ বড়সড় বদল ঘটে চলেছে পরিবারে, সমাজে। কোমলমতি বলে সমাজে চিরকাল প্রশ্রয় পাওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলাই যেখানে বেয়াদবি বলে বিবেচিত হতো এই সমাজে, সেখানে হরহামেশা অনেক শিক্ষক হচ্ছেন লাঞ্ছিত। ছাত্রের অসত্য অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের স্কুলশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেফতার করে জেলে নেওয়ার ঘটনা ঘটল এই সেদিন। এটাই প্রথম ঘটনা ছিল না শিক্ষক হেনস্তার। শেষ ঘটনাও নয়। ঘটনা ঘটেই চলেছে, বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মহাবিদ্যালয়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও। ঘটনা আজকাল আর বেয়াদবি কিংবা হেনস্তায় সীমিত থাকছে না। এমনকি ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে নিজ ছাত্রের বেপরোয়া হামলায় গুরুতর আহত হন ঢাকার আশুলিয়ার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান তিনি।

নড়াইলে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। কিন্তু কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করায় সংকট রয়েই গেল। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে পর্যন্ত কঠোর না হবে, শুধু দুঃখ প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে ততদিন এ সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। রাষ্ট্র যে পর্যন্ত শিক্ষকের পাশে না দাঁড়াবে, শিক্ষকদের জাতি তৈরির কারিগর হিসাবে শুধু কাগজে কলমে নয় আচার ব্যবহারে মর্যদা না দিবে, ততক্ষণ এ পরিস্থিতির সমাধান অসম্ভব। পরিবার-সমাজের শিক্ষায় বেড়ে ওঠা কিশোর শিক্ষক কে? তা যদি নাই বোঝে তাহলে তাকে ঠিক করা সহজ নয়। এত আলোচনা-সমালোচনার পরেও এটাই সত্য যে, শিক্ষক লাঞ্ছনা থেমে নেই। কিন্তু কেন এসব ঘটনা ঘটে চলেছে? কেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই প্রধান উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী।

তারা বলেন, পরিবারে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। বাচ্চারা সঠিক শিক্ষা পায় না। অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের রোল মডেল হতে পারছেন না। কোনো বিষয়কে এত সহজে সরলীকরণ করা যায় সেটা মনে হয় না। কারণ শিক্ষক ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে এটা বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। এর মধ্যে বাবা-মা রোল মডেল হতে না পারার সংকট দেখা দিল, শিক্ষকের সংকট চলে আসলো? এর পেছনে যে ধর্মীয় রাজনীতির উস্কানি ক্রমশ বাড়ছে সেটা আলোচনায় কম আসেনি। মুন্সীগঞ্জের শিক্ষক ‍হৃদয় মণ্ডল থেকে নড়াইলের ঘটনা সবই কিন্তু ধর্মীয় উস্কানি। এর পেছনে কারা এটা বের করা প্রয়োজন আগে। শিক্ষকদের ওপর হামলার পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনায় ভুক্তভোগীদের তালিকায় রয়েছেন ঢাকার তেজগাঁও কলেজশিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের রুমা সরকার, নারায়ণগঞ্জ স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্জয় সরকার ও উমেশ রায়, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার স্কুলশিক্ষক মিলটন তালুকদার এবং নওগাঁ স্কুলশিক্ষক আমোদিনী পাল।

সরল চোখে দেখলেই বোঝা যায় একটি মহল জল ঘোলা করে তাতে মাছ শিকার করতে চায়। কারণ সামনে নির্বাচন। রাষ্ট্র এসব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। যাতে শিক্ষা ব্যবস্থাই গুরুত্ব হারাবে। যে দেশের জাতিগড়ার কারিগর শিক্ষকরা ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হয়, আর রাষ্ট্র বসে সব পর্যবেক্ষণ করে চুপ থাকে-সে দেশের যত উন্নয়ন হোক সব ম্লান হয়ে যায় এক এক জন শিক্ষকের অসম্মানে। শিক্ষা ব্যবস্থা সেখানে কতোটা অবহেলিত সেটা বোঝা যায় সহজেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Exit mobile version