স্মৃতি একাত্তর

 ।। ইকতিয়ার চৌধুরী ।।

ডিসেম্বর ’৭১। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম গেরিলা দল ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’ তখন কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে  ১১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নওগাঁয় পাকিস্তানি বাহিনীর ২০৫ ব্রিগেডের ৩২ বেলুচ রেজিমেন্টকে প্রায় ১২ ঘণ্টার এক ঘোরতর সম্মুখযুদ্ধে নিশ্চিহ্ন করার পর তারা রসদহীন হয়ে পড়ায় আশ্রয় নেয় রৌমারীতে। রৌমারী তখন মুক্তাঞ্চল। আমরা ৭০০-৮০০ গেরিলা সেখানে পৌঁছে থানা প্রাঙ্গণে অনেক পরিত্যক্ত তাঁবু পেলাম। কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যুবকরা প্রশিক্ষণ শেষে চলে গেছে রণক্ষেত্রে। তাদের দীপ্ত পদভারে প্রকম্পিত স্থানটি এখন দ্বিপ্রহরের মতো উদাস। আশপাশের বাংকারগুলো খালি, কারণ যুদ্ধক্ষেত্র এখন সীমান্তের আরো অভ্যন্তরে স্থানান্তরিত হয়েছে। অপরাহ্নে গেরিলাদের খাবারের ডাক আসায় বুঝলাম প্রশিক্ষণ শিবিরটির ব্যবস্থাপনা সচল। থালা হাতে লাইনে দাঁড়ালাম। খিচুড়ি পড়ল পাতে। শুধুই খিচুড়ি। নরম করে রান্না করা, যাতে গলায় আটকে না যায়। 

নওগাঁর যুদ্ধ ছাড়াও আমরা পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের গেরিলারা (এফএফ, বিএলএফ বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বিডিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র-জনতার সম্মিলিত বাহিনী) ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জার পরিচালনায় ৭ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় চারবার মুখোমুখি যুদ্ধ করি পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আর রৌমারী আসার পথে একবার ইসলামপুর থানার যমুনার চরে পাকিস্তানি এয়ার ফোর্সের সঙ্গে। এছাড়া গেরিলারা বিভিন্ন সময়ে ফরিদপুর (পাবনা) ও তাড়াশ থানা, সলঙ্গা রাজাকার-মিলিশিয়া ঘাঁটি দখল করে নেয়। আমরা সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদী রেলপথের সেতুগুলোর পাহারায় স্থাপিত মিলিশিয়া-রাজাকারদের ক্যাম্পগুলোও  বারবার আক্রমণে তছনছ করে দিই। এগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য কালিয়াহরিপুর, বংকিরাট, দিলপাশার, কইডাঙা রেল ব্রিজগুলো। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পলাশডাঙ্গার ‘সিভিলিয়ান মিলিটারি লিডাররা’ দেশের ভেতরে থেকে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। প্রয়াত পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জা ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লিডার ছিলেন বিএলএফের সিরাজগঞ্জ দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডার, রাকসুর তত্কালীন জিএস, পলাশডাঙার উপপরিচালক আব্দুস সামাদ (প্রয়াত), সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের তত্কালীন ভিপি, শিবিরের সর্বাধিনায়ক সোহরাব হোসেন, সহকারী সর্বাধিনায়ক সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস বিমল কুমার দাস, সাংস্কৃতিক জন সহকারী পরিচালক মনিরুল কবীর (প্রয়াত) প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার নওগাঁ ছাড়া দেশের কোথায়ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তাদের নিশ্চিহ্ন করার নজির নেই। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ১৫৩ জন এবং তাদের দোসর ৬৯ জন রাজাকার প্রাণ হারায়। ৩২ বেলুচের কমান্ডার ক্যাপ্টেন সেলিম আটজন সেনাসহ আত্মসমর্পণ করেন। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে যুদ্ধে সিভিলিয়ান মিলিটারি লিডারদের অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি।

যুদ্ধের পর একটি সনদ পেয়েছিলাম, যার এখন আর সেই অর্থে মূল্য নেই। কারণ দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং পচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা মিলে সামরিক শাসকসহ বিভিন্ন সরকারের সময়ে শত শত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার জন্ম দিয়ে প্রকৃত যোদ্ধাদের মর্যাদা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সারিতে তারা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তথাকথিত শব্দ-কলম সৈনিক, শিল্পী সৈনিক, খেলোয়াড় সৈনিক ইত্যাদিসহ নানা তরিকার হাজার সৈনিককে। প্রার্থনা করি মৃত্যু আর অশ্রুর মাঝে জন্ম নেয়া আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ সুরক্ষিত থাক।

ইকতিয়ার চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ,কথাসাহিত্যিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত

 

Exit mobile version