১৯৯৬ সালে সুরত মিয়াকে ঢাকা বিমানবন্দরে হত্যা ২০০১ সালে বিমানের ট্রানজিট হোটেল থেকে কিডন্যাপ ও খুন মুঘল কুরাইশি ২০১১ সালে রচডেলের হাজি তাহির আলী খুন হন বিশ্বনাথে ২০১২ সালে ১২ বছরের ছেলের সামনে ১৮ বার ছুরিকাঘাতে রেহানা হত্যা ২০১৯ সালে শ্রীমঙ্গলে রিহ্যাবে খুন হন জালাল উদ্দিন ২৬ জুলাই ২০২২ পিতা-পুত্রের রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ এখনো অজানা
সেই সুরত মিয়ার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? যারা ব্রিটেনে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন তাদের এই সুরত মিয়ার কথা ভোলার নয়। ১৯৯৬ সালের ৯ মে বাংলাদেশ এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি জোনের ভিতরে কাস্টমস কর্মকর্তারা মিলে হত্যা করেন এই ব্রিটিশ বাংলাদেশিকে।
সেই সুরত মিয়ার হত্যার পর থেকে গত ২৬ জুলাই রফিকুল ইসলাম ও তার সন্তান মাহীকুল ইসলামের ট্র্যাজেডি মিলিয়ে অন্তত পাঁচটি পৃথক ঘটনায় সাতজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আজ পর্যন্ত কোনো হত্যার বিচার হয়নি। এ যেন বিচারের বাণী কাঁদে নিভৃতে।
১৯৯৬ সালের ৯ মে নিউক্যাসলের ৩৫ বছর বয়সী রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সুরত মিয়া কেএলএমের ফ্লাইটে নামেন ঢাকার বিমানবন্দরে। সেখানে কাস্টমস কর্মকর্তারা ঘুষ দাবি করলে প্রতিবাদ করেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুরের বাসিন্দা ব্রিটিশ বাংলাদেশি সুরত মিয়া। সাংবাদিক নবাব উদ্দিন বলছিলেন সেই ঘটনা। তিনি বলেন, তরুণ রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সৈয়দ সিরাজ ওরফে সুরত মিয়া ঢাকায় নামার পর তার কাছে থাকা ক্যাশ ৪ হাজার পাউন্ডের দিকে নজর যায় এক মহিলা কাস্টমস কর্মকর্তার।
সেই মহিলা সুরত মিয়ার কাছে ঘুষ দাবি করেন। তখন সুরত মিয়া চ্যালেঞ্জ করেন। সেখানে বাগবিতাণ্ডার এক পর্যায়ে কাস্টমসের কর্মকর্তারা মিলে হামলা করেন সুরত মিয়ার ওপর। এক পর্যায়ে তাকে কাঠের টুকরা দিয়ে আঘাত করা হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সুরত মিয়া। তারপর কাস্টমসের কর্মকর্তারা মিলে প্রথমে চিন্তা করেন বডি বাইরে ফেলে দিতে। তবে তা সম্ভব হয়নি। তারা সুরত মিয়াকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে মৃত ঘোষণা করা হয় তাকে। সুরত মিয়ার হত্যার পর কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ নামেন আন্দোলনে। সেই আন্দোলন একসময় মাটিচাপা পড়ে যায়। সেই আন্দোলন সম্পর্কে বলছিলেন তখনকার সময়ে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়াদের অন্যতম কে এম আবু তাহের চৌধুরী।
তিনি বলেন, তখন ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আন্দোলনে নামেন। বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তন হলে বিচারের আশ্বাস দেওয়া হলে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকের পরামর্শে আমরা আন্দোলন থেকে সরে আসি। পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বিচার চাই। বাংলাদেশে এখান থেকে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়। সেই প্রতিনিধি দল চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য এনে উপস্থাপন করেন। দুঃখের বিষয় হলো কোনো কিছুই কাজে লাগেনি।
নবাব উদ্দিন বলেন, চারজন কাস্টমস কর্মকর্তাকে দায়ী করে চার্জশিট দেওয়া হয়। কিন্তু প্রমাণের ঘাটতি দেখিয়ে এরা রেহাই পেয়ে যায়। সেই বিচার আর হয়নি। সুরত মিয়ার পরিবার এখনো নিউক্যাসলে থাকে। বাবা হত্যার বিচার না পাওয়ার বেদনা এখনো কুরে কুরে খায় সন্তানদের।
২০০১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে হত্যার শিকার হন ব্রিটিশ বাংলাদেশি মুঘল কুরাইশি। সেই ঘটনা বলছিলেন সাংবাদিক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট আহাদ চৌধুরী বাবু। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা ২২ বছর বয়সী ব্রিটিশ বাংলাদেশি যুবক মুঘল কুরাইশি। তিনি ইস্ট লন্ডনের স্ট্রাটফোর্ডে থাকতেন। সিলেট থেকে বিমানের ফ্লাইটে উঠে ঢাকায় বিমানের নির্ধারিত ট্রানজিট হোটেল থেকে সকালে কিডন্যাপ হন তিনি। তাকে ছাড়াই বিমান ছাড়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে। দুই দিন পর ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ১০ মাইল দূরে উদ্ধার হয় তার লাশ।
পুলিশি তদন্তে বলা হয়, পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিতে হত্যা করা হয় এই যুবককে। মুঘল কুরাইশি হত্যার পর বিমান অফিস ঘেরাও করে বিরাট আন্দোলন করা হয়। কিন্তু সেই বিচার হয়নি আজও। ২০১১ সালের ২৬ জুন রচডেল এলাকার এক মুরুব্বি হাজি তাহির আলী বাংলাদেশে সিলেটের বিশ্বনাথে যাওয়ার পর মুখোশধারীদের আক্রমণে হত্যার শিকার হন। ধারণা করা হয় জমিসংক্রান্তে বিরোধের কারণে এ হত্যা করা হয়। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ঘটনারও বিচার হয়নি।
ছবিতে যে নারীকে দেখছেন তিনি রেহানা বেগম, থাকতেন স্টেপনি গ্রিন এলাকায়। শখের গার্ডেনার ছিলেন। স্থানীয় হেলথ সেন্টারে কাজ করতেন। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই স্বামী ও ১২ বছরের সন্তান নিয়ে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার পাটলি গ্রামে যান। ২ আগস্ট ১২ বছরের সন্তানের সামনে ১৮ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় তাকে। নিজ আত্মীয়দের মধ্যেই ৪ জন সোনা আর টাকার জন্য হত্যা করে এই নারীকে। আজ পর্যন্ত এর বিচার হয়নি। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীমঙ্গলের একটি রিহ্যাব সেন্টার থেকে উদ্ধার করা হয় জালাল উদ্দিন নামের এক ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুণের লাশ।
চিকিৎসার জন্য সেখানে ভর্তি করেছিলেন তার পরিবার। পেয়েছিলেন শরীরে অসংখ্য আঘাতে জর্জরিত লাশ। এই ঘটনারও বিচার হয়নি। সর্বশেষ ট্র্যাজেডি ঘটেছে কার্ডিফ নিবাসী রফিকুল ও তার ছেলে মাহীকুলের কপালে। কী ঘটেছে সেটাই ঘটনা ১০ দিন পর্যন্ত জানা যায়নি। সর্বশেষ খবর হচ্ছে পুলিশ এখনো অপেক্ষা করছে চট্টগ্রাম ল্যাব থেকে ভিসেরা রিপোর্ট আসার।
সাংবাদিক আহাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশে মামলা মোকদ্দমা আর জমিসংক্রান্ত নানা ফ্যাসাদে আক্রান্ত। হয়রানির শিকার হয় প্রবাসীরা নানা ক্ষেত্রে। প্রবাসীরা যতদিন টাকা পাঠাতে পারেন ততদিনই রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আর যেদিন থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ সেদিন থেকে দেশের বোঝা।’