।। সাদেকুর রহমান ।।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর নবম মাসে এসে একে একে সাফল্য ধরা দিতে শুরু করে। বীরবিক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যঅর্জনের মাস হয়ে ওঠে ডিসেম্বর। ২ ডিসেম্বর বাংলার দামাল সন্তানেরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতিদিন কোণঠাসা হতে থাকে পাকবাহিনী। নভেম্বরের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। আর এদিকে দেশজুড়ে চলছিল অদম্য প্রতিরোধ। মুক্তিবাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হচ্ছিল পাক হানাদার বাহিনী। এইদিনের বড় অর্জন হচ্ছে ঘোড়াশালে মুক্তিবাহিনীর ২৭ পাক হানাদার খতম।
মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরে আকস্মাৎ এমন এক হামলা চালায় যার জন্য প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান বাহিনী। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ব উত্তরের জনপদ পঞ্চগড় মুক্ত করে এগিয়ে চলছিল ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ঢাকার রামপুরা ও মালিবাগে এদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমসমূহে তখন মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়।
একাত্তরের এ দিনে মুক্তিযোদ্ধারা যখন রাজধানী ঢাকাকে দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাকার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছিল নানা অপপ্রচার। এ দিকে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে প্রতিদিন শহীদ হচ্ছিল হাজারও মুক্তিকামী জনতা। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছিল না মা-বোনেরা।
নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আখাউড়া রেল স্টেশনে চলে সম্মুখযুদ্ধ। একাত্তরের এই দিনে ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এদিন মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর চার দিক থেকে আক্রমণ করে ২৭ জন পাকহানাদারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এখান থেকে মুক্তিবাহিনী বেশ কিছু গোলা-বারুদ হস্তগত করে।
আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও ক্ষিপ্ত পাকবাহিনী তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনী পিছু সরে আসতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তিন দিক থেকে শত্রুকে আক্রমণ করলে পাকবাহিনী আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের দখলে আনতে সক্ষম হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পটিয়া থানা তাদের দখলে আনার জন্য মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত আছে।
মুক্তিবাহিনী বর্তমান নেত্রকোনার বিরিশিরির বিজয়পুরে পাক অবস্থানের ওপর অ্যামবুশ করে ৫ জন পাকহানাদারকে হত্যা করে। এখান থেকে মুক্তিবাহিনী রাইফেলসহ ২১ জন রাজাকারকে ধরতে সক্ষম হয়।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে কংগ্রেস দলের এক কর্মীসভায় ভাষণ-দানকালে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেই লাখ লাখ বাঙালি স্বদেশে ফিরে গিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে পারবে।
পাক কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে একদল রাজাকার সঙ্গে নিয়ে কাঁঠালি গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে এলে মুক্তিবাহিনীর সেকশন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন এবং ৩নং সেকশন কমান্ডার আবদুল ওয়াহেদের নেতৃত্বে পরিচালিত অতর্কিত আক্রমণে তিন জন পাকহানাদার ও ৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন পাকসেনা আহত হয়। পরে পাকহানাদাররা লাশগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার নেতারা পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার লক্ষ্যে অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ভারত আক্রমণ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আবেদন জানান।
ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের মিত্রশক্তি ছিল এবং তৎকালীন পরাশক্তি রাশিয়া ভারতকে সমর্থন যুগিয়েছিল। আর পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল অপর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এ দুইটি দেশ নানাভাবে পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতাও করেছিল। এ বিষয়ে আবদুল ওয়াহেদ তালুকদার তার ‘৭০ থেকে ৯০ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১-এর মার্চ মাসে। এই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে ভারতের অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ ভারতের প্রচার মাধ্যমগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছিল যে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের অজুহাতে বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছিল তা প্রতিহত করা বাইরের পৃথিবীর নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিসমূহ তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবেশগত কারণে জড়িয়ে পড়ে।… পাকিস্তানের প্রতি চীনের অকুণ্ঠ সমর্থনের পেছনে যে কারণ বিদ্যমান তা হলো, চীন নিজেই একটা বহুজাতিক রাষ্ট্র। তাই তার ভাষায় বাঙালিদের এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সমর্থন করা যায় না। আর বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা তার (চীন) ভাষায় কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রমিক-কৃষক-জনতার সমর্থনপুষ্ট একটা গণযুদ্ধ ছিল না। বরং কিছুসংখ্যক বুর্জোয়া নেতা শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের জন্য পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল মাত্র।”
এদিকে, তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ পত্রিকার খবর অনুযায়ী এ দিন একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাব করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের কাছে যে পত্র দিয়েছে তা নিরাপত্তা পরিষদে বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষক চেয়ে ইয়াহিয়ার এ পত্র দেয়ার ব্যাপারটি ছিল নিজেদের ভূমিকাকে পরিচ্ছন্ন রাখার একটা কৌশল মাত্র। একই দিন আমেরিকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগাশাহী নিউইয়র্কে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ভারতীয় দাবিকে অদ্ভুত বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া এদিন জুলফিকার আলী ভুট্টোর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সত্যিকার প্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়। ভুট্টো পিপিপির কোয়ালিশনে যোগ দেবার গুজবকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন।