রজত রায় : বাজেটের ঘোষণা আসছে। ৯ জুন জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে। বাজেট এলেই দেখা যায় ‘কেমন বাজেট হওয়া উচিত’-এ ব্যাপারে বিভিন্নজনের মতামত চাওয়া হয়।
এটা খুব সুন্দর গণতান্ত্রিক রীতির পরিচায়ক। দেশ চালাতে যে বিপুল অঙ্কের প্রশাসনিক ব্যয় হয়, বাজেটের বড় একটি অংশ দখল করে রাখে সেই ব্যয়। আর বাজেট নিয়ে যত নেতিবাচক কথাই বলা হোক না কেন, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের চিত্র উজ্জ্বল হয় সেসব বাজেট বরাদ্দ থেকেই। গোটা বিশ্বের অর্থনীতি অতিমারি ও মন্দায় জর্জরিত। তাই আর্থিক নীতির রূপরেখা অর্থনীতির অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। মানুষ কর্মহীন হয়েছে।
দৈনিক মজুরেরা দীর্ঘ সময়ের জন্য কর্মচ্যুত হয়ে পথে বসেছেন। রোজগার না থাকায় বেশিরভাগ মানুষের আয় সংকুচিত হয়েছে। তাই দিন যাপন করার জন্য সবারই জমানো পুঁজিতে হাত পড়েছে। যারা দারিদ্র্যসীমাকে ইদানীংকালে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন, রোজগার না থাকায় আবারও দরিদ্র হয়েছেন, যারা দরিদ্র ছিল তারা হয়েছে দরিদ্রতর।
করোনা আমাদের কাজের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে। করোনার কারণে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমেছে, ফলে মানুষের আয় কমে গেছে। আয় কমে যাওয়ার ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাবে। তাই অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব ফিরিয়ে আনা জরুরি। অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। রাজস্ব আদায় কম হলে করজাল বাড়াতে হবে। অনু উৎপাদনশীল খাতের ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতের ব্যয় বাড়াতে হবে। কারণ কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। কর্মযজ্ঞ সৃষ্টিতে সরকারকেই ভূমিকা নিতে হবে। আর তাই উৎপাদনশীল খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতেই বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী এখনো রয়েছে করোনা মহামারির রেশ, কবে কাটবে কেউ জানে না। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশ্বব্যবস্থার এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, গম ইত্যাদি খাদ্যপণ্যের বাইরে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এর প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরেও। বাজেটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কৃষি, মৎস্য ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের মতো খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে ১০-১২ শতাংশ কর্মসংস্থান আনুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে নিয়মিত বেতন ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তাদের রয়েছে। কিন্তু বাকি ৮৮-৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান অনানুষ্ঠানিক খাতের। ফলে, অর্থনীতিতে যে কোনো আঘাত এলে দেশের এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দ্রুতই বিপদে পড়ে।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সূচকের ঊর্ধ্বগতি নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জোগান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। বিদ্যুৎ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের কৃষি, শিল্প, সেবা খাতসহ দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের অস্তিত্ব ছাড়া জীবন কল্পনা করা অসম্ভব। অর্থনীতিতে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি এবং গতি আনতে বিদ্যুৎ সুবিধা শক্তিশালী অনুঘটক হিসাবে কাজ করছে। সহনীয় দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারার বিষয়টা বাজেটে বিবেচনায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশে খেতে-খামারে দ্রুত উৎপাদন বাড়ছে। তাতে আমরা সমস্যাও দেখতে পাচ্ছি। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। বিপণন প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছে একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া বা ব্যবসায়ী। উৎপাদন মৌসুমে ধানের মূল্য থাকে কম, পরে তা বেড়ে হয়ে যায় দ্বিগুণ। তখন কৃষকের ঘরে আর ধান থাকে না। এর লাভ পুরোটাই নিয়ে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী চালের আড়তদার ও চাতাল মালিক। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে যেমন দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে পুষ্টিকর খাদ্য ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হবে। অন্যথায় ভয়াবহ খাদ্য ও পুষ্টি সংকটে পড়বে দেশ। পশুখাদ্য তৈরির সব ধরনের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে বাজেটে ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন। চলতি মৌসুমে ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক আলুর আবাদ হয়েছে। ফলনও হয়েছে আশাতীত। আলু যখন প্রথম বাজারে আসে তখন দামও ছিল বেশি। সব আলু যখন উত্তোলন হলো, তখন আলু সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে রাখার আর জায়গা নেই। জায়গা স্বল্পতার কারণে হিমাগারে আলু রাখার স্থান হচ্ছে না। তাই আলু সংরক্ষণে কৃষকদের বাড়িতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। বাজেটে কৃষি পণ্য সংরক্ষণাগারের নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
যমুনার বুকে জেগে ওঠা চর এখন কৃষি পরিবারে অর্থনৈতিক অবদান রাখছে। বর্ষার পর পানি নেমে গেলে পলি পড়ে জমির উর্বরতা শক্তি বেড়ে যায়। ফলে, প্রচুর পরিমাণ নানা ধরনের সবজিসহ বাদাম, ভুট্টা, গম, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ধানসহ ব্যাপক ফসলের চাষ হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ কৃষি বিভাগের তথ্য মোতাবেক চলতি বছর যমুনা চরে ৭৪০০ হেক্টর ভুট্টা, ৫১৪০ হেক্টর বাদাম, ১০০০ হেক্টর মরিচ, ৩৫০০ হেক্টর খেসারি, ২৫৫০ হেক্টর মসুর, ৩৪৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়েছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় সবজি সহজে অন্যত্র নিতে না পারার কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারছে না। তাই বাজারজাত ব্যবস্থাপনার জন্য কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। তার জন্য চরে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজ বাহন বা যানবাহনের ব্যবস্থা করে কৃষকদের ন্যায্যমূল্যের ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে হবে।
আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত রাখতে হবে এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হবে। বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র ৪ ভাগে তেল ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধিতে মাঠ পর্যায়ে আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য এলাকাভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা জরুরি। কৃষকদের উন্নত বীজ সরবরাহ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে তেল বীজ ফসলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। তাহলে আমদানিনির্ভরতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনপ্রতি আয় ছিল ১০০ মার্কিন ডলারের নিচে। অর্ধশতাব্দী পর এখন তা উন্নীত হয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলারে। তবে আয় বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে দেশে তেমন উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং অবনতি হয়েছে। তাই এ বৈষম্য কমাতে হবে। বৈষম্য রয়েছে গ্রাম ও শহরের জীবনধারায়। এগুলো দূর করতে হবে। এজন্য দরকার গ্রামীণ অর্থনীতির বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করা, পুঁজি গঠন ও আয়বর্ধন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা।
করোনা প্রভাব মোকাবিলা এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পর্যাপ্ত সৃজনশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়নের জোয়ার ও দেশের উন্নতি আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ-সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে যদি নিত্যপণ্যের দাম জনগণকে কষ্ট দেয়। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো ও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি চেইন ঠিক রেখে সাপ্লাই চেইন সচল রাখার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।
রজত রায় : অর্থনীতিবিষয়ক লেখক