সন্ধান২৪.কম ডেস্ক ঃ ভারতের পশ্চীমবঙ্গের একটি পূজামণ্ডপে তৈরি অসুরমূর্তি—যার মুখাবয়ব মিলে গেছে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। এর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বাংলাদেশে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও চলছে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড়।
মুর্শিদাবাদের কয়েকটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে মহিষাসুরের স্থানে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড.মহম্মদ ইউনূস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ৷ কোথাও দেবীর হাতে অসুরের ছিন্ন মস্তকের জায়গায় দেখা গেছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের ছিন্ন মস্তক ।
তবে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের একটি পূজামণ্ডপে “ইউনূসাসুর” তোলপাড় ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশে । বাংলাদেশের মিডিয়া এই ঘটনাকে বলছে “শিষ্টাচারবহির্ভূত” কাজ ৷ এমনকি এতে দু’দেশের মধ্যে ‘কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে’ বলেও মন্তব্য করা হয়েছে ।
উল্লেখ্য,মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর খাগড়া সাধক নরেন্দ্র স্মৃতি সংঘের দুর্গাপূজামণ্ডপের প্রতিমা নিয়ে আপত্তির ও প্রতিবাাদের ঝড় উঠেছে ভারত ও বাংলাদেশে। কারন, প্রতিমায় এবার মহিষাসুরের স্থানে বাংলাদেশের সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূসের মূর্তি গড়া হয়েছে । দেবীদুর্গা ত্রিশুল দিয়ে বিদ্ধ করেছেন অসুরের বক্ষ । আর তাঁর বাহন সিংহ অসুরের বাম দিকে থাবার নখ বসিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে । শুধু ইউনূসকেই নয়, অন্য দুটি পূজামণ্ডপের একটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, অন্যটিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে অসুররূপে নির্মাণ করা হয়েছে।
এই ঘটনায় সোসালমিডিয়া,পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন ভাবে নিন্দা ও সমালোচনা করেছেন অনেকে।
সুবাস চন্দ্র দাস বলেছেন,‘জানিনা এআই প্রযুক্তি কিনা। যদি সত্যি এটা হয়ে থাকে তাহলে ইহা অতি উৎসাহী উন্মাদদের ধর্মজ্ঞানহীন ঘৃন্য কর্ম।’
আশীষ কুন্ডু লিখেছেন,‘তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এমন বিকৃত মানসিকতার জন্য।’
সৈয়দ রেজভী মন্তব্য করেছেন, ‘এভাবে ধর্মের কার্যক্রম উপস্থাপিত হলে যদি সেখানে উপস্থিত সকলে জোড়ালো প্রতিবাদ না জানায় তাহলে সেই ধর্মের গুরুত্ব কমে যায়। হিংসা কখনো কোন ধর্মে নাই। এত বড় দেশ কেন যে ছোট্ট একটা দেশের সরকার প্রধানকে ভয় পায় বুঝতে পারছিনা।”
সুদীপ্ত এসডি বলেছেন, “এগুলা আবার করা ঠিক না। শান্ত-শিষ্ট পরিবেশ টাকে গরম করার ধান্দা। বাঙালির স্বভাব-ই ওইরকম খোঁচা-খোচি না করলে ভালো লাগে না। পরে ওরা কিছু করলে তারপর বলবে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। এই জন্যই বলে, “এক হাতে তালি বাজে না।”
এম ডি ইউসুফ উদ্দিন সুজন বলেছেন,“ইলিশ কি কম হয়ে গেছে নাকি?”
প্রশান্ত প্রতীম চক্রবর্তী ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন,“সনাতন ধর্ম শান্তি এবং বিদ্বেষবিরোধী ধর্ম। মায়ের পুজো মায়ের নিয়মে করুন। অসুরের এমন প্রতিকৃতি মোটেই কাম্য নয়। এসব অপকর্মের তীব্র নিন্দা জানাই।”
এম ডি সিরাজুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন, “এটাই কি হিন্দুদের ধর্ম ? জানতে চাই দাদাদের কাছ?”
ফিরোজ ইফতেখার মাসুম বলেছেন, “মুর্শিদাবাদের মানুষজন অনেক আগে থেকেই গোঁড়া, শিক্ষার হার খুব কম, অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি, গরীব মানুষের সংখ্যা প্রচুর, ওখানে মানুষ মানুষকে সম্মান করে না, যেখানে নিজেদের মানুষই সম্মান পায় না, সেখানে অন্য দেশের নোবেল জয়ী মানুষের মর্যাদার কি বুঝবে ঐ অশিক্ষিত এলাকার বাসিন্দারা।”
প্রতিমা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিডি নিউজ ২৪ ডট কম-এর সাংবাদিক শাহেদ কায়েস । সাংবাদিক শাহেদ কায়েস মন্তব্য করেছেন, ’পূজামণ্ডপে সরকারপ্রধানদের মুখাবয়ব ব্যবহার করে অসুরের প্রতিকৃতি নির্মাণ—একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে বিতর্কিত কাজ হয়েছে। পুরাণ প্রতীককে এমন মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনাটা কতখানি শিল্পীর স্বাধীনতা বলে বিবেচিত হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যায়।’
ওই বাংলাদেশি সাংবাদিক লিখেছেন,’কাজটা সন্দেহাতীতভাবে শিষ্টাচারবহির্ভূত হয়েছে। শুভ ও অশুভের প্রতীকী লড়াইয়ের মঞ্চ যে দুর্গাপূজা, সেখানে ভিনদেশের একজন সরকারপ্রধানকে অসুর রূপে প্রতীকায়িত করা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের একটি পূজামণ্ডপে তাই করা হয়েছে। সেখানে অসুররূপে হাজির করা হয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে। স্থানীয় শিল্পীদের এই সিদ্ধান্ত শুধু শিল্পরুচির প্রশ্নেই বিতর্কিত নয়—এটি সীমান্তপারের সম্পর্ক, কূটনৈতিক শিষ্টাচার এবং সামাজিক সম্প্রীতির ওপর সরাসরি আঘাত হানার সামিল।’
তিনি বলেছেন,’শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমারও কিছু ক্ষোভ আছে এবং বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার তা থাকতেই পারে। সর্বশেষ পাহাড়ে যখন আগুন জ্বলছে, মানুষ মরছে, আমি কিছুতেই সরকারের ভূমিকা মেনে নিতে পারছি না। অন্তত সেই সরকারের ভূমিকা আমাকে বিব্রত করছে, যে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাকে একদা আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে বিস্তর কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু আমি ভুলে যাইনি, দেশের এক ক্রান্তিকালে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে এই সরকারটি। মুহাম্মদ ইউনূস কী করছেন, আরও কী করবেন, সেটা দেখার সময় শেষ হয়ে যায়নি। তাই মেনে নিতে পারছি না বহরমপুরের পূজামণ্ডপে করা কাণ্ডটা।’
তার কথায় মুর্শিদাবাদের ওই দুর্গাপূজামণ্ডপে মুহাম্মদ ইউনূসকে অসুরের মুখে রূপায়ণ করার ঘটনাটি নিছক শিল্পরুচির বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এর ভেতরে রয়েছে দীর্ঘ সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস ও অভিবাসন জনিত মানসিকতার প্রতিফলন।ঐতিহাসিকভাবে মুর্শিদাবাদ একটি সংবেদনশীল অঞ্চল। নবাবি আমলের রাজধানী হিসেবে এটি সবসময় রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল। পরবর্তীতে দেশভাগ, শরণার্থী সংকট এবং সীমান্ত রাজনীতির কারণে এখানকার মানুষের মানসিক ভুবন সবসময় বাংলাদেশসংক্রান্ত ঘটনার সঙ্গে সজাগ থেকেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এবং পরবর্তী কয়েক দশকে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অভিবাসী হিসেবে স্থায়ী হয়েছেন। মুর্শিদাবাদ ছিল তাদের অন্যতম আশ্রয়স্থল। সীমান্ত ঘেঁষা এই জেলার সামাজিক গঠন তাই বহুলাংশে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত থেকে গেছে। স্থানীয় হিন্দুদের পারিবারিক শেকড়, ভাষা ও সংস্কৃতির অনেকাংশ আজও বাংলাদেশ কেন্দ্রিক—তারা ওখানে বসবাস করলেও ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার পালাবদল এবং সাম্প্রতিক সময়ে ড. ইউনূসকে ঘিরে বিতর্ক মুর্শিদাবাদের মানুষের কল্পনাশক্তিতে প্রতিফলিত হয়েছে। যারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক আলোচনাকে প্রতিদিনের খবরে, আত্মীয়-স্বজনের গল্পে, কিংবা স্মৃতিতে বহন করেন, তাদের কাছে বাংলাদেশ শুধুই একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়—বরং আত্মপরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত একটি মানসিক ভূগোল। ফলে পূজামণ্ডপের শিল্পীরা যখন ‘অসুর’ চরিত্র নির্মাণ করতে গিয়েছেন, তারা স্থানীয় মানুষের রাজনৈতিক আবেগকেও শিল্পে প্রতিফলিত করেছেন।
তিনি লিখেছেন,যদিও বাংলাদেশ সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য আসেনি, অন্তত আমার চোখে পড়েনি, তবু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে, সাধারণ মানুষ এ ঘটনাকে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্প্রীতি নষ্টের উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো কূটনৈতিক শিষ্টাচার। রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক যে কোনো কর্মকাণ্ডে অন্য দেশের নেতৃত্বকে অসম্মান করা কেবল অনভিপ্রেত নয়, বরং বিপজ্জনকও বটে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক বন্ধনে জড়িয়ে আছে দুই দেশ। এই সম্পর্ককে ক্ষুণ্ন করার মতো কোনো পদক্ষেপ তাই গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না আসলেও জনমতের চাপ এই ঘটনায় ভবিষ্যতে কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে।
পাশাপাশি তিনি আরও বলেছেন,এই ঘটনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দুই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। বাংলাদেশ ও ভারত— উভয় দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রায়শই সামাজিক বৈরিতার শিকার হন। ধর্মীয় উৎসব যখন বিদ্বেষ বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতীক হয়ে ওঠে, তখন এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর। অথচ পূজা-পার্বণের মূল বার্তা হওয়া উচিত সম্প্রীতি, ঐক্য ও মানবিকতার। বিভেদের প্রতীক হিসেবে পূজার ব্যবহার হলে তা কেবল উৎসবের মহিমাই ক্ষুণ্ণ করে না, বরং সমাজে নতুন উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে পারে।