সন্ধান ২৪.কম:ভাষা আন্দোলনের সময়কাল সচরাচর নির্দেশিত হয়, ’৪৮ থেকে ’৫২। সত্য বটে, তবে ইতিহাসের নিরিখে বেশ কিছু অন্তর্নিহিত সত্য তা হলে আড়ালে থেকে যায়। ইতিহাস একটি আন্দোলনকে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে হাজির করে; এবং তার ফলে ঘটনাটির পূর্বাপর আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ইতিহাসচর্চায় এক ধরনের সামগ্রিকতা থাকে, যা গতানুগতিক আলোচনায় থাকে না। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এযাবৎ যা লেখা বা বলা হয়েছে, তাতে ঘটনাবলির অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে (যা প্রশংসনীয়), কিন্তু ইতিহাসের পূর্বাপর বা সামগ্রিকতা নেই। উপরন্তু ভাষা আন্দোলনের গ্রহণযোগ্য মানের কোনো ইতিহাস নেই। এ আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। জাতীয় ব্যর্থতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না থাকাও। অথচ আমাদের শ্লাঘার কথা, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ গৌরব আর অহঙ্কারের অধ্যায়। এ তো সবারই জানা, ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। সে তো অনেক কথা, তবে এখন শুধু ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা হোক।
ভাষা আন্দোলনের শেকড় খুঁজতে হবে পেছনে গিয়ে। কারণ ইতিহাস বলে, কোনো ঘটনা আচম্বিতে বা আকস্মিকভাবে ঘটে না। ভাষা আন্দোলনের শেকড় উপনিবেশ ভারতের একটি ঘটনায় নিহিত আছে। ১৮৬৭-তে বেনারসে হিন্দু নেতাদের একটি সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত ছিল, ভারতের একমাত্র ভাষা হবে হিন্দি। জানা কথা, হিন্দুদের ভাষা ছিল হিন্দি; এবং যার বড় একটি কারণ লিপি দেবনাগরি। অর্থাৎ সিদ্ধান্তটির মধ্যে ধর্মীয় আবেগ ছিল। বিপরীতে লক্ষণীয়, মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু, যা আরবি হরফে লেখা হতো। সুতরাং উর্দু ভাষার সঙ্গেও মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ জড়িত ছিল। উল্লেখ্য, এখনো সৌদি আরবে পাকিস্তানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়; কারণ তাদের ভাষা আরবি হরফে লেখা। অর্থাৎ সৌদি-পাকিস্তানি এক ধরনের ভাষিক নৈকট্য আছে। এটা বোধগম্য যে, ১৮৬৭-র বেনারস সভার সিদ্ধান্ত ভাষার ধর্মীয়করণ, রাজনীতিকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছিল, যার ফল বিষময় হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
বেনারস সভার সিদ্ধান্তের প্রতি উর্দুভাষী মুসলমানদের প্রতিক্রিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিল স্যার সৈয়দ আহমদ খানের দিকনির্দেশক মন্তব্য। তিনি দিল্লির কমিশনার আলেকজান্ডার শেক্সপিয়ারকে লিখেছিলেন, এ ঘটনার পর হিন্দু-মুসলমান মিলনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ্র জীবনীকার হেক্টর বোলিথো এ কারণে মন্তব্য করেছিলেন, জিন্নাহ স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ভবিষ্যদ্বাণী রূপায়ণ করেন। হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বহুবিধ কারণ নির্দেশ করা যেতে পারে, কিন্তু ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার সূচনা ১৮৬৭ থেকেই। লক্ষণীয়, ১৮৬৭-র পর থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত হিন্দি ও উর্দু ভাষা ঘিরে হিন্দু ও মুসলমানের জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ও বিকাশ হয়েছিল। হিন্দি-উর্দু বিতর্ক যে, হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্বের বীজ বপন করেছিল তা চর্চিত ইতিহাসের বয়ানসমূহে অনুপস্থিত, যা নিঃসন্দেহে ইতিহাসচর্চার সীমাবদ্ধতা।
উর্দু ভাষা যে মুসলমানের ভাষা, ইসলামি ভাষা- এমন একটি অযৌক্তিক ধারণা থেকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করেছিলেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কারণ তিনি মনে করেছিলেন, পাকিস্তান হবে মুসলমানের ইসলামি রাষ্ট্র। উপাচার্য মহোদয় তার সীমিত জ্ঞান নিয়ে ইসলামি আবেগে এমন আচ্ছন্ন ছিলেন যে, তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হয় গরিষ্ঠের ভাষা; এবং সে সুবাদে বাংলার দাবি ছিল অগ্রগণ্য। বাংলা মাতৃভাষা ছিল পাকিস্তানের ৫৪ (৫৬ নয়) শতাংশ নাগরিকের। উর্দু ছিল প্রায় ৬.০৭ শতাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা। অবশ্য এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজাদ পত্রিকায় লিখে বেশ জোরালোভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, প-িত ড. শহীদুল্লাহ পা-িত্যে ও ইসলামি চিন্তা-চেতনায় অনতিক্রম্য হলেও, আবেগী ধর্মান্ধ ছিলেন না; তথ্যভিত্তিক যুক্তির কাছে তিনি বরাবরই আনুগত্য স্বীকার করতেন।
ইসলামি আবেগ মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্র মধ্যেও ছিল। ইসলামকে পুঁজি করেই তিনি উপনিবেশ ভারতে মুসলমানের নেতা হয়েছিলেন, নিজের গুজরাটি নাম ঝিনাহ্ পুন্জা বদলিয়ে হয়েছিলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ; এবং তা মুসলমানপ্রিয়তার স্বার্থে। তার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট এমনিই। অথচ ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন কৃতবিদ্য পশ্চিমী ধাঁচের আগাগোড়া আধুনিক মানুষ। বোধগম্য যে, ব্যক্তিসত্তা ও রাজনৈতিক সত্তার মধ্যে পার্থক্য করে জিন্নাহ পরস্পরবিরোধী সত্তার ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ব্যক্তি জিন্নাহ আর মুসলমানের নেতা জিন্নাহ এক ছিলেন না।
জিন্নাহ ’৪৮-এ ঢাকায় এসে ২১ ও ২৪ মার্চ যখন রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সপক্ষে দাম্ভিক উক্তি করেন, তখন তিনি তা করেন ইসলামি আবেগের বশবর্তী হয়ে। অবশ্য এটাও মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে, তিনি লঘিষ্ঠের ভাষা গরিষ্ঠের ওপর চাপিয়ে দিয়ে প্রভুত্ব বিস্তারের সুপ্ত বাসনাও লালন করেছিলেন; যা ছিল পাকিস্তানি মানসিকতার প্রতিফলন, এবং যে মানসিকতা পাকিস্তান ’৭১ পর্যন্ত ধারণ করেছিল। অর্থাৎ জিন্নাহ লঘিষ্ঠের প্রাবল্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানের (পড়ুন পশ্চিম পাকিস্তান) পথদ্রষ্টা ছিলেন। এ কারণেই ’৪৬-এর এপ্রিল মাসে দিল্লি মুসলিম লেজিসলেটরস্ কনফারেন্সে তার নির্দেশে এবং সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেট্স’ হয়ে গিয়েছিল ‘স্টেট।’ অর্থাৎ দুই পাকিস্তানের পরিবর্তে হয়েছিল এক পাকিস্তান। জিন্নাহর এমন মানসিকতার বহির্প্রকাশ ছিল ২১ ও ২৪ মার্চের ঘোষণা।
জিন্নাহ মৃত্যুর আগে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের কাছে দুটো ভুল স্বীকার করেছিলেন। এক. ‘স্টেট্স’কে ‘স্টেট করা। দুই. উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভুল শোধরানোর আর উপায় ছিল না। জিন্নাহর উত্তরসূরিরা তার ভুলকে আঁকড়ে ধরে পাকিস্তান পরিচালনা করার কারণে ’৭১ অনিবার্য হয়েছিল। উল্লেখ্য, জিন্নাহর দুটো ভুলই প্রভুত্ব-প্রয়াসী ছিল। পাকিস্তানের ভাঙন প্রমাণ করেছিল, মানুষের ওপর মানুষের অন্যায় প্রভুত্ব টেকসই হয় না। ইতিহাস তাই বলে। জিন্নাহও বোধহয় তার অন্তিম মুহূর্তে এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন।
ভাষা আন্দোলন যে ’৪৭ থেকেই শুরু হয়েছিল, তার আরও বাস্তব কারণ আছে। এক. ১৭ আগস্ট ২৭ বছরের তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতার সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকার সম্পাদকের ঘরে এক আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কারণ ভাষাটি গরিষ্ঠ নাগরিকের ভাষা। বাঙালিপ্রিয় শেখ মুজিবের মুখে এমন কথা মানায়। উল্লেখ্য, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, তিনি রেসকোর্সের ভাষণে বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। বাংলার মাটি আমার স্থান।’ সুতরাং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সমান্তরালে শেখ মুজিবুর রহমানকেও ভাষা আন্দোলনের দ্রষ্টা বলা যুক্তিসঙ্গত। অবশ্য শেষোক্ত জন স্রষ্টাও ছিলেন। কারণ ভাষা আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা তো ইতিহাস।
দুই. ভাষা-বিতর্কের প্রেক্ষাপটে ’৪৭-এর ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ১৫ সেপ্টেম্বর পুস্তিকা প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু। বলা বাহুল্য, পুস্তিকাটি প্রকাশের পর ভাষা বিতর্কটি বিদ্বৎসমাজে মুখ্য বয়ানে পরিণত হয়।
অর্থাৎ ’৪৮-এর ১১ মার্চ হরতালের মধ্য দিয়ে রাজপথের ভাষা আন্দোলন সূচিত হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ’৪৭ থেকেই। তাই ভাষা আন্দোলনের সময়কাল ’৪৭ থেকে ’৫২; ’৪৮ থেকে ’৫২ নয়।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)