মানব পাচার ও মুক্তিপণ আদায়ের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী উদ্ঘাটন

ইরাকে মানব পাচার, অপহরণ ও নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে শ্যালক-দুলাভাইকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে জানা গেল মানব পাচার ও মুক্তিপণ আদায়ের এক শ্বাসরুদ্ধকর ও হৃদয়বিদারক কাহিনী। গত সপ্তাহে রাজধানীর ফকিরেরপুল ও ফরিদপুর থেকে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো—ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার ৬ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জসীম উদ্দিন ফকির (৪৫) এবং তার শ্যালক মাহবুবুর রহমান (২৫)। তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিকাশে টাকা-পয়সা লেনদেনের নানারকম ডকুমেন্টস, মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করা অর্থ ব্যাংকে জমা দেওয়ার রশিদ, ব্যাংক চেক ও স্মার্ট ফোন; যাতে আছে অপহরণ, মানব পাচার সংক্রান্ত নানা রকম স্হিরচিত্র, অডিও এবং চ্যাট হিস্ট্রি। জসিম উদ্দিন ফকির ২০১৭ সাল থেকে পরবর্তী দেড় বছর ইরাকে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান করে রপ্ত করেছে মানবপাচার এবং নির্যাতনের নানা কৌশল। জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে ২০১৭, ২০১৯ সালেও মানব পাচার আইনে একাধিক মামলা হয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী অন্য সহযোগী নারী-পুরুষ পাচারকারীদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান এসব তথ্য জানিয়েছেন।

কীভাবে পাচার হয়: ইরাকের বিমানবন্দর, হাসপাতাল, হোটেল, দোকান ও কনস্ট্রাকশন সাইটে চাকরির কথা বলে ভিজিটর হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়া হয়ে দুবাই এবং সেখান থেকে ইরান হয়ে ইরাকে লোক পাঠানো হয় ভিজিটর ভিসায়। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিশেষত বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে ৪ থেকে ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে লোক পাঠানো হয় প্রতারণামূলকভাবে। মানবপাচারকারী চক্রটি মূলত তিন মাসের ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে লোকজন দুবাই পাঠায়। সেখানে চক্রের সদস্য তাহেরসহ অন্যরা ভিজিটরদেরকে রিসিভ করে ১৫ থেকে ২০ দিনের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখে। পরে দুবাই থেকে ভিজিট ভিসায় পাঠানো হয় ইরানে। সেখান থেকে পোর্টের মাধ্যমে আকাশ পথে অথবা বাসে করে পাঠানো হয় ইরাকে। ইরানের ভিজিট ভিসা, টিকিট ও থাকা-খাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। পরবর্তীতে চক্রটি ইরাকের বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদেরকে আটকে রেখে নির্যাতন করে এবং নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের সদস্যদেরকে দেখিয়ে বিকাশে ও হুন্ডির মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা আদায় করে।

অপহরণকারী চক্র: জসিম ফকিরের আপন ভাই জহিরুল ইসলাম ২০১২ সাল থেকে ইরাকে অবস্থান করে নিজস্ব স্বজন গোষ্ঠীকে নিয়ে তৈরি করেছে অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়ের একটি শক্তিশালী চক্র। এই জহিরুল ইসলাম এবং কিরকুকে অবস্থানরত শিহাব উদ্দিন, জিয়া, সুলতান আহমেদ স্থানীয় ইরাকি বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকারদের সহযোগিতায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের অত্যাচার-নির্যাতন করে বাংলাদেশে অবস্থানরত সহযোগীদের মাধ্যমে ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। ইরাকে অবস্থানকারী হাবিব ,আক্কাস, বাবলু মোল্লা, মমিন এবং মমিনের ভাই আকরাম এই মানব পাচার চক্রের অন্যতম সদস্য।

কারা অপহৃত হয়: মূলত ইরাকের বাগদাদ, বসরা, কিরকুক এবং আরবিল—এই চারটি শহরে শ্রমিকদের ওয়ার্ক পারমিট বা আকামা দেওয়া হয়। এসব ভিকটিমদের পাসপোর্টের ওপরে যে শহরে আকামা দেওয়া হয়, সেই শহর ব্যতীত অন্যান্য শহরে ভিকটিমরা অবৈধ হয়ে পড়ে। যে প্রতিষ্ঠানে ভিকটিমদের পাসপোর্ট জমা নেয় সেই প্রতিষ্ঠানে উক্ত শ্রমিক এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়ে। কোম্পানি কর্তৃক পাসপোর্ট জমা রাখায় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার স্বাধীনতা থাকে না। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পালানো শ্রমিক, পাসপোর্ট হারানো শ্রমিক ও কাজ না পাওয়া শ্রমিকরা অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের শিকার হন।

মুক্তিপণের টাকা লেনদেন: বাংলাদেশে অবস্থানরত অপহরণকারী চক্রের সদস্য জসিম ফকির ও মাহাবুব হোসেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিকাশ নম্বর সংগ্রহ করে ইরাকে পাঠায় এবং ইরাক থেকে উক্ত বিকাশ নম্বর ভিকটিমদের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। ঢাকায় অবস্থানরত অপহরণকারী চক্রের সদস্য মাহবুব উক্ত বিকাশের টাকাগুলো উত্তোলন করে তার দুলাভাই জসিম ফকিরের নিকট পাঠায় যা পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের কাছে বণ্টিত হয়।

Exit mobile version