মে দিবস নতুন অঙ্গীকারে

বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত বলে সংকট আরও বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী দুঃখজনক এ চিত্রই আমরা দেখছি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনও বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় কর্মহীনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। ভয়াবহ তথ্য হলো, সারাবিশ্বে অনানুষ্ঠানিক খাতে দেড় শতাধিক কোটি তথা শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেকেরই জীবিকা এখন ঝুঁকিতে পড়েছে।

আমরা জানি, ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ধর্মঘট পালনরত শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রক্তদানের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল এক নতুন ইতিহাসের। সামাজিক উৎপাদনে যন্ত্রচালিত কারখানা এসে যখন বাড়িয়ে তুলছিল শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা, তাদের ১২ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটিয়ে নির্মম শোষণ ও পুঁজির দাসত্বে বেঁধে রাখা হচ্ছিল, তখন সেদিনের আন্দোলনে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা কেবল দিনের তিনভাগের একভাগই নির্ধারণ করা হয়নি, একই সঙ্গে দিবসটি শ্রমিকদের যথাযথ মর্যাদাও নিশ্চিত করেছে।

কিন্তু চলমান করোনা-দুর্যোগ এমনি অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, খোদ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে কিংবা দুর্যোগ অবস্থা কেটে গেলেও এর মন্দ প্রভাব যে উৎপাদনমুখী শিল্প ও এর শ্রমিকের ওপর পড়বে, তা বলাবাহুল্য। আমরা মনে করি, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ঋণ ছাড় ও এ ব্যবস্থা সহজ করাসহ প্রণোদনার যথাযথ সুফল তারা যেন পায়।

এটা অনস্বীকার্য যে, শ্রমিকশ্রেণি যেকোনো দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা শুধু উৎপাদন ব্যবস্থারই প্রধান শক্তি নন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেরও অন্যতম কারিগর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বে এখনও শ্রমিকদের নানামুখী বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রদান, সময়মতো বেতন-ভাতা প্রদানসহ তাদের সঙ্গে ভালো আচরণের ব্যাপারে রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। ন্যায্য পাওনা আদায়ে মালিকের দ্বারে দ্বারে ঘোরা এমনকি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার চিত্রও এখানে কম নয়।

এটা সত্য যে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে দেশে শ্রমিকদের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত করণীয় আরও অনেক কিছু বাকি। আর চলমান করোনা-দুর্যোগের কারণে আমাদের সম্মিলিত সে দায়িত্ব আরও বেড়েছে। আমরা দেখেছি অনেক শিল্পেই শ্রমিকের গত মার্চ মাসের মজুরি প্রদানে গড়িমসি হয়েছে, অনেকে ঠিকমতো মজুরিও পাননি। এখন লকডউনে থাকা গত হওয়া এপ্রিল মাসের মজুরি নিয়ে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে, তা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। আমরা চাইব, এসব ক্ষেত্রে সরকার এগিয়ে আসুক। মনে রাখা দরকার, এ মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য পবিত্র ঈদুল ফিতরের বোনাসও এর বাইরে নয়।

পোশাক শিল্পে শ্রমিকরা কাজে ফিরেছে, আমরা দেখতে চাইব করোনা সুরক্ষায় কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে। এ স্বাস্থ্যবিধি ও সতর্কতা মেনে সীমিত পরিসরে হলেও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানও খোলার ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। স্বাভাবিক সময়ে শ্রমিকের নিরাপত্তায় মালিকপক্ষের যে দৃষ্টি ছিল, এ সময়ে তাতে আরও মনোযোগ বাড়ানো চাই। আমরা মনে করি, মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষের মধ্যে ঐক্য যত সুদৃঢ় হয়, উভয় পক্ষেরই সমৃদ্ধি তত ত্বরান্বিত হয়।

নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে এবারের মে দিবস হোক নতুন অঙ্গীকারের। এ দুর্যোগে আমরা শ্রমিকের পাশে দাঁড়ালে করোনা-পরবর্তী দেশকে এগিয়ে নিতে তারা সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমরা শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।◉

Exit mobile version