ভাষা সৈনিক মতিয়ার রহমান এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের নাম-সনজীবন কুমার

ভাষা সৈনিক মতিয়ার রহমান এক অগ্নিস্ফূলিঙ্গের নাম

সনজীবন কুমার

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বে দেশ ভাগ হলো। মি.জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লিগেরও সভাপতি।
সেই সময় ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ইংরেজিতে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং অন্য কোন ভাষা না। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।”
এর প্রতিবাদে সারা দেশের হাজার হাজার ছাক্র-জনতা প্লে­কার্ড,পোষ্টার-ফেস্টুন নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”শ্লোগানে বাংলার মাটি র্থ র্থ কেঁপে ওঠে।
সেই আন্দোলন থেকে গাইবান্ধার সংগ্রামী জনতাও পিছিয়ে ছিল না। তারাও মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বুকের রক্তদিতে প্রস্তত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে নির্ভীকচিত্তে। সেই সময় পুরো গাইবান্ধা জেলা হয়ে ওঠে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

 

মা ও ভাইয়ের কাছে লেখা চিঠি
স্ত্রী নূরজাহানের কাছে লেখা চিঠি

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতা হতাহত হবার খবর গাইবান্ধায় পৌঁছালে সেখানকার জনসাধারণ ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। সিদ্ধান্ত নেয়, মি.জিন্নার এই অন্যায় ঘোষনার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেই হবে। এর জন্য ১৯৫২ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে গাইবান্ধা শহরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম একটি কমিটি গঠন করা হয়। ভাষা সৈনিক মতিউর রহমানকে সভাপতি ও হাসান ইমাম টুলুকে সাধারণ সম্পাদক করে এই কমিটি হয়। সহ-সভাপতি ছিলেন গোবিন্দগন্জের মজিবর রহমান ও গাইবান্ধার খন্দকার আজিজুর রহমান। কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন কাজী আব্দুল হালিম,এ্যাড.খান আলী তৈয়ব,শাহ ফজলুর রহমান,গোলাম মোস্তফা,শাহ নুরননবী, বিধুভূষন,কার্জন আলী,গোলাম কিবরিয়া ও খোরশেদ মিয়া।
সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মতিউর রহমানের নেতৃত্বে গাইবান্ধায় লাগাতার হরতাল,মিছিল-মিটিং,আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকে। ‘নুরুল আমিনের ফাঁসী চাই,রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে গাইবান্ধা শহর। এই আন্দোলনে ভয় পেয়ে যায় শাসক মুসলিম লীগ। তাদের সমর্থক ও কর্মীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একের পর এর মিথ্যা মামলা দিতে থাকে। এই আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য ১৯৫২ সালের মে মাসে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তসাত মাস পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে মতিউর রহমানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন আরও তীব্র হয়। উপায় না দেখে, ১৯৫৪ সালে পাকজান্তা আবার মতিউর রহমান ও হাসান ইমাম টুলুকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদিন কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে।


মতিয়ার রহমানের সবচেয়ে বড় যে অহংকার তা হচ্ছে, তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৫২ সালে পুলিশ মতিয়ার রহমানকে তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমা শহর থেকে আটক করে কোমরে দড়ি এবং হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রংপুর জেলে। মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে সংগ্রামী এই নেতাকে একটানা সাত মাস জেল খাটতে হয়েছে।
মতিউর রহমান যখন জেলে ছিলেন, তার কয়েকদিন পর শুরু হয়েছিল রমজান মাস। রোজার সময় ছেলে জেলে থাকবে ভেবে মায়ের কষ্ট বেড়ে যায়। সান্ত¦না দিতে ১৯৫২ সালের ১৭ মে জেল থেকে মতিয়ার রহমান প্রিয় মাাকে চিঠি লেখেন। ওই চিঠির নিচের অংশে ভাইকেও কয়েক লাইন লিখেছিলেন। ওই একই দিনে আর একটি চিঠি লিখেছেন তার স্ত্রী নূরজাহানের কাছে। সেই চিঠির একটি অংশে লেখা ছিল“আমি কবে ফিরবো তার নিশ্চয়তা নেই। কাজেই আমার জন্য কোন চিন্তা না করে-সাজু টুকুদের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে বাঁচতে হবে। ওরাই আমার-তোমার দেশের ভবিষ্যত। ওরাই প্রতিষ্ঠা করবে আমার আদর্শ।”
কিন্ত কোন দমণ-পীড়নই সর্বজন শ্রদ্ধেয় গাইবান্ধার লড়াকু ভাষা সৈনিক ‘মতিভাই’কে দাবিয়ে রাখতে পারে নাই।তাইতো বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সৈনিক মহান মুক্তিযুদ্ধেও বীরদর্পে যুদ্ধ করে এনে দিয়েছেন-একটি দেশ, একটি পতাকা। তাইতো গাইবান্ধার রাজনৈতিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত¦ মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান যেন এক প্রজ্জ্বল কিংবদন্তি।
সাবেক পাকিস্তানিদের শাসনামলে, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সকল গণ আন্দোলনেই মতিয়ার রহমানের সংগ্রামী ভূমিকা ছিল। এজন্য তাকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। উনসত্তুরের গণ আন্দোলনে তিনি যখন জেলে তখন তার স্ত্রী মারা যায়। রক্ত দেয়ার অভাবে বিনা চিকিৎসায় তার স্ত্রীর মৃত্যু হলেও সে সময়ে রাজনৈতিক সাথীরাও ভয়ে তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসায় কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকি জেল কর্তৃপক্ষ মৃত স্ত্রীর শেষ কৃতকর্মেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়নি ত্যাগী মানুষ মতিয়ার রহমানকে।
আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবেই তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
মতিয়ার রহমান রাজনৈতিক জীবনে মাওলানা ভাসানি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অনেক জাতীয় নেতৃত্বের সান্নিধ্যে আসার এবং একসাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।
রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবনের পাশাপাশি একজন ফুটবলার হিসেবে ‘মতিভাই’ বাংলাদেশসহ ভারতেও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে গাইবান্ধার টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন হিসেবে সেন্টার ফরওয়ার্ড এ ফুটবল খেলার সূত্রপাত করে তিনি জাতীয় পর্যায়ের ফুটবল টুর্নামেন্ট গুলোতে সাফল্যের সাথে খেলেছেন। এছাড়া কোলকাতা মোহামেডানের একজন নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ভারতে বড় বড় ম্যাচ খেলেছেন। মোহনবাগানের সাতে একটি খেলায় তিনি একাই তিনটি গোল করে হ্যার্ট্রিক করার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
তার ৭ ছেলে ৬ মেয়ে সন্তানদের মধ্যে শাহনেওয়াজ টুকু, শফিউল আজম রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে সংগ্রামী ভূমিকা রেখে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এছাড়া পুত্র মাহমুদ হোসেন (আইয়ুব) পিতার খেলোয়ারী জীবনের অনুসরণে জাতীয় ফুটবল দলে খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
এক সময়ের বলিষ্ঠ প্রতিবাদের প্রতীক, গণমানুষের সোচ্চার কণ্ঠস্বর সর্বজন শ্রদ্ধেয় মতিয়ার রহমান তাঁর অবদানের জন্য জাতীয় কোন স্বীকৃতি পাননি।
যে লোকটিজীবনভর শুধু মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়ে গেলেন,যে মানুষটির আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাঙালি জাতি পেয়েছে তাদের প্রাণের মাতৃভাষা ও একটি দেশ, আজও তিনি চরম অবহেলায়-অবজ্ঞায় বর্তমান প্রজন্মের কাছে অচেনাই থেকে গেলেন। তবু এই বাংলার বুকে চির অম্লান হয়ে থাকবে মতিউর রহমানদের এই ত্যাগ এবং দেশপ্রেম।
১৯৩৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী মতিউর রহমান গাইবান্ধা শহরের মমিন রোডে জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০০৬ সালের ১০ মে এই শব্দ সৈনিকের মৃত্যু হয়।

Exit mobile version