দেলোয়ার জাহিদ : পদ্মা বাংলাদেশের একটি প্রধান নদী। পৃথিবীর যে কোন দেশে পাড়ি জমানো যায় এ নদী দিয়ে। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা যা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় (মানাকোসা ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন) হয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশে আর সেখান থেকেই এ নদীটি নাম ধারণ করেছে “পদ্মা” ।
বিশ্বের মুক্ত-প্রবাহিত অনেক নদীর আবাসস্থল হলো বাংলাদেশ। বিশ্বের দীর্ঘতম নদীগুলোর মাত্র এক তৃতীয়াংশ এখনো অবাধে প্রবাহিত হয়। যেখানে পদ্মা নদী, বাংলাদেশের বৃহত্তর গঙ্গা (গঙ্গা) নদীর প্রধান চ্যানেল যা প্রায় ৯০ মাইল (১৪৫ কিমি) গঙ্গা, পদ্মা নদীর উপরের অংশ হিসাবে কুষ্টিয়া জেলার উত্তর প্রান্তে বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পশ্চিম সীমানা তৈরি করে। সে খরস্রোতা প্রমত্ত পদ্মা নদীর সাথে এতদঞ্চলের মানুষের অনেক সুখ দুঃখের হাসি কান্নার লোকগাথা জড়িত রয়েছে।
সে পদ্মা নদীর তীরে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা আশির দশকের প্রথম দিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো। দৈনিক বাংলার ব্যানার হেডিংয়ে খবর ছিল এ উপজেলার পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং সেখানকার মানুষের অবর্ণনীয় সব দুর্দশার কথা. কুমিল্লা থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রী ও ঔষধপত্র সহ একটি টিম নিয়ে রওয়ানা হলাম রাজশাহী। সেখানে পৌঁছে জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করলাম এবং একটি দুর্গম অঞ্চলে যাওয়ার অভিপ্রায়ের কথাও জানালাম । অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের এ মিশনের তথ্য দিলেন। পরদিন রাজশাহীর স্থানীয় একমাত্র দৈনিকসহ মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হলো আমাদের উপস্থিতির কথা। তখন অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই যোগাযোগ হলো রাজশাহীতে কর্মরত মিশনারি একটি সংস্থার সাথে। তারা আমার সাথে মিটিং করলেন এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য বরাদ্ধ ও একটি ব্যতিক্রমী শর্ত জুড়ে দিলেন তা হলো আমার যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী প্রয়োজন আমি তা বিতরণের জন্য নিতে পারবো তবে আমার টিমকেই তা বিতরণ শেষ করে কুমিল্লা ফিরে যেতে হবে। খুলে না বললেও বুঝতে বাকি রইলোনা না যে প্রশাসনের উপর তাদের এক রত্তি বিশ্বাস ও আস্থা নেই… চারঘাটের দুর্গত ও অভুক্ত মানুষের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলাম এবং মিশনে নেমে পড়লাম। টিমের সাথে কর্ম্মপরিকল্পনা তৈরি করলাম। আবারো জেলা প্রশাসনের সহায়তা চাইলাম দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট দেয়ার জন্য। তারা ত্রাণসামগ্রী ওদের মাধ্যমে বিতরণের জন্য চাপ দিতে শুরু করলেন। এমতাবস্থায় আমার মামা বিডিআর সেক্টর কমান্ডার রাজশাহী লে. কর্নেল আলাউদ্দিনের সহায়তা চাইলাম। তিনি বিডিআর এর ড্রাইভার সহ দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট্য স্পিড বোট ও জেলা প্রশাসন থেকে মাঝারি ধরনের একটি লঞ্চ নিয়ে দিলেন। প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি মালামাল নিয়ে চারঘাট পৌঁছলাম এবং পানির মাঝে জেগে থাকা একটি বাড়িতে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে উঠলাম । আমার টিমে মির্জা বাকের আহমেদ নামের একজন তরুণ-স্কুলের ছাত্র ছিল (যে পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হয়ে অবসর নিয়েছে)। এছাড়া অন্যরাও ছাত্র এবং কুমিল্লা দক্ষিণ ঠাকুরপাড়ার ঝিলমিল সংঘ এর স্বেচ্ছাসেবী, যে প্রতিষ্ঠানের টানা দশ বছর আমি সাধারণ সম্পাদক এবং ডাক্তার জহিরুল ইসলাম (বর্তমানে মরহুম) নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবীরা যদিও প্রশিক্ষিত এবং এক দশকে হেন ত্রাণ তৎপরতা নেই যে তাদের কেউ না কেউ এগুলোতে অংশ নিয়েছে তারপরও পদ্মার ভয়ংকর রূপ এবং ঢেউয়ের গর্জন হৃদয়ে মোচড় দেয়ার মতো। নৌকা নিয়ে কয়জন জনপ্রতিনিধি দেখা করতে এলেন তাদের বললাম আমরা প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে ক্যাটাগরি করে সে অনুযায়ী ত্রাণ দেব এবং তাই করলাম।
আমি ও বিডিআর এর ড্রাইভার উত্তাল ঢেউয়ের বুক চিরে পালাক্রমে টিম মেম্বারদের নিয়ে ৩-৪ দিনে ত্রাণ বিতরণ করে শেষ করলাম এরই মাঝে রাজশাহীতে লঞ্চ ফিরে গেছে। আমাদের ফিরতি যাত্রা স্পিডবোটে। আমি তখন অনেকটা ক্লান্ত, শ্রান্ত শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরেছিলাম আমার হাত তখন কাঁপছিলো মনে অজানা আতঙ্ক! ফিরে যেতে পারবো তো রাজশাহীতে?
রাজশাহী প্রেস ক্লাব সন্ধ্যায় আমাদের সম্মানে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করল; যা সমন্বয় করলেন সাংবাদিক শফি । প্রশাসন ও মিশনারির লোকজনও সেখানে এলেন, তাদের প্রশংসা ও ভালোবাসায় সিক্ত হলাম আমরা। জবাবে আমি শুধু বললাম আপনাদের ভালোবাসা ও প্রার্থনা আমাদের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। ‘৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের পর এমন সন্মানবোধ আর কখনো হয়নি- আমি ও আমার টিমের পক্ষ থেকে সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীকে ঘিরে আমার রয়েছে অনেক সুখ, দুঃখ ও হাসি কান্নার স্মৃতি তাই প্রবাসে থেকেও পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। ১৮ কোটি মানুষের উচ্ছ্বসিত অপেক্ষায় থাকা এক বিস্ময়কর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ নির্মাণ করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নসাধের পদ্মাসেতু। সাহসিনী প্রধানমন্ত্রী ও পদ্মাকন্যা শেখ হাসিনা কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন।
এবার ‘পদ্মাকন্যা’ উপাধি পেলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি দেশরত্ন, জননেত্রী, মাদার অব হিউম্যানিটি এবং কওমি জননী উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
গত ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভায় বিষয়টি উঠে আসে।
সভায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সভার সভাপতিত্ব করেন। আর দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ গণভবন থেকে সভা সঞ্চালনা করেন।
আলোচনায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপা, গতকাল আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। পদ্মা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে আছে। পদ্মাপারের লাখো কোটি মানুষ সাহসী ও সাহসিকতার জননী ‘পদ্মাকন্যা শেখ হাসিনাকে’ এক নজর দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে।’ (জুন ২৩, বাংলা ইনসাইডার)
সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার অজুহাতে পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিলের আবদার করে একটি মহল। তাই ২২ জুন প্রাক-উদ্বোধনী সংবাদ সংম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানান যে, বিভিন্ন বাহিনীর শতাধিক বোট, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য যানবাহন উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৫০০ জন সদস্য ৭টি হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমানসহ সিলেট এলাকায় উদ্ধারকার্য পরিচালনা ও ত্রাণ বিতরণের জন্য সার্বক্ষণিক নিয়োজিত আছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠন- ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাবেসক লীগ, কৃষক লীগের নেতাকর্মীদের দুর্গত মানুষদের সহায়তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজ চালাচ্ছেন। তিনি নিজে সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্র্শন করেছেন। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যা কবলিত সিলেট অঞ্চলে ১ হাজার ২৮৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ৩০০ মেডিকেল টিম কাজ করছে।
বনা কবলিত ১১টি জেলায় ৯০০ মেট্রিক টন চাল এবং ৩ কোটি ৩৫ লাখ নগদ টাকা এবং ৫৫ হাজার শুকনা এবং অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির। আমরা তার ব্যবস্থাই করছি। আমাদের দলের নেতাকর্মীরাও সাধ্যমত দুর্গত মানুষের ঘরে শুকনো এবং রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় পানি কমতে শুরু করেছে। আশা করা হচ্ছে দুই-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। বন্যার পানি নেমে গেলে বাড়িঘর মেরামত এবং কৃষি পুনর্বাসনের কর্মসূচি হাতে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের নির্দিষ্ট করে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকার জনসাধারণকে আশ্বাস দিতে চাই, সরকার আপনাদের পাশে আছে। মানুষের ভোগান্তি লাঘবে আমরা সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। (সূত্র : ২২ জুন বাসস )
‘পদ্মাকন্যা’ শেখ হাসিনার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে যে ট্রেন তৎপরতা চলছে তা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দেশের সক্ষমতার পরিচয় দেয়। স্মৃতির পাতা খুলে ফিরে দেখি একাত্তরের ৪ জুলাই মুক্তিযুদ্ধা নুরু, আতিক ও মোহন মেঘনাপাড়ের ভৈরব বাজারে এক দুঃসাহসী অভিযান চালায়। মমতাজ পাগলাসহ কয়েকজনকে হত্যা করে, আতিক ঘটনাস্থলে শহীদ হন ও নুরু আহতাবস্থায় ধরা পড়ে, তাকেও আশুগঞ্জ মেঘনা পাড়ে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়। জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে বালুচরে লুটিয়ে পড়েন নুরু। মুক্তিযোদ্ধা নুরু আমার মামা ও আতিক এবং মোহন সম্পর্কে ভাই।
১৯৮৬ সালের বর্ষায় আমার সম্পর্কে এক ছোটবোন তাওসীন আরা চিনু তার মেয়ে পিয়া (৬) ও পুত্র পাভেল (৩) এর যমুনায় নৌকা ডুবিতে সলিল সমাধি ঘটে। কালো শাড়ি পড়া দুই বগলের নিচে দুই শিশুকে নিয়ে একটি লাশ ভেসে যেতে দেখেছে যমুনা পাড়ের মানুষ। যুগে যুগে কতশত মায়ের বুক খালি হয়েছে এ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় তার হিসেবে কে রাখে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন কে ঘিরে গোটা বিশ্বে বসবাসকারী বাঙালি জাতি উদ্বেলিত, আনন্দিত ও গর্বিত। কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ যখন সমাগত তখন আসুন আমরা ‘বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য পদ্মাকন্যা’কে স্বাগত জানাই। জয় বাংলা!