শীতে অবস্থা কাহিল। শরীরটা চাঙ্গা করার জন্য জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় গরম গরম চা পান করছি। এমন সময় টিডি ব্যাংকের দিক থেকে চাচা হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে ছুটে আসলো। হাতটা চেপে ধরে বললো-ভাতিজা একটু এলমহার্স্ট হাসপাতালে যাওয়া লাগবে।
চাচার মুখটা দেখে আমার বুকটা ধক্ ধক্ করে উঠলো। বললাম কেন চাচা ?
-চলো খুব দরকার।
কি হয়েছে,কার অসুখ,কেন চাচা হাসপাতালে যাচ্ছে ? এসব প্রশ্ন করতেই আমার ভয় লাগছিল। হঠাৎ যদি কোন বড় দু:সংবাদ শুনতে হয়,সেই ভয়টা ছিল।
বাহে ভাতিজা তোমার হাতে ছবি খুব ভালো হয়। সেই জন্য তোমাক নিয়া যাচ্ছি। এ কথা বলার সময় দেখি চাচার মুখে এক টুকরা হাসি ফুটে উঠলো।
তখন আমি সাহস করে বললাম-চাচা কি ঘটনা ? কার কি হয়েছে ?
-ভাজিতা আমার এক নেতা অনেক দিন থেকে অসুস্থ্য, তাকে দেখতে যাচ্ছি।
চাচাকে বললাম,কে হাসপাতালে আছে ?
চাচা-কমিউনিটির এক লিডার।
তখন আমি কিছুটা হেসে বললাম- চাচা তুমিই তো এই কমিউনিটির বড় লিডার। তোমার উপরেও লিডার আছে?.
-ভাজিতা সব কিছু যদি বুঝতে পারতা তা হলে তো কাজই হতো। সেরের উপরেও সোয়া সের থাকে ভাজিতা। আমার উপরেও নেতা আছে।
হাসপাতালে গিয়ে দেখি, বেডে একজন মানুষ শুয়ে আছে,অবস্থা খুব কাহিল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বিদ্ধস্ত চেহারা, চোখ-মুখ গর্তে। আধা ঘুমে জোরে জোরে নি:শ্বাস নিচ্ছে।
তখন চাচা নেতাকে আস্তে আস্তে ডাকা শুরু করলো। নেতা বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকালো। কিন্ত তার অবস্থা দেখে মনে হলো তাকানেরও শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তবু চাচার দিকে তাকালো। এর পর চাচা নেতার হাতে ফুল তুলে দেয়ার জন্য রেডি হলো। আমাকে ঈশারা করলো ছবি তোলার জন্য। আমি এই থমথমে পরিস্থিতিতে ছবি তুলবো কি তুলবো না এমন দ্বিধা নিয়ে আছি। চাচা চোখ গরম করে বললো-ভাতিজা ছবি তোল। কি আর করি ছবি তুলতে হলো। চাচা আবার রোগির পিছনে গিয়ে দাড়ালো এরপর আর একটি ছবি তুলতে বললো। এবার চাচা বহু কসরত করে নেতাকে আধা শোয়া করে বললো,লিডার চিন্তা করেন না,দুই/ একদিনের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে বাড়িতে যাবেন। একটু হাসি-খুশী না থাকলে ভাবি-ভাতিজি মন খারাপ করে থাকবে। রোগী হাসলো কি হাসলো না তা বুঝতে পারলাম না। কিন্ত চাচা একটু মোলায়েম হাসি দিল। আমি কয়েকটাা ছবি তুললাম।
তার ছবি তো শেষ হলে বললো, ভাতিজা আস, তুমি একটা ছবি তোল। আমি বললাম, না চাচা ঠিক আছে। তবু চাচা খুব পিড়াপিড়ি করতে লাগলো। আমি নানা ছুয়াত এড়িয়ে গেলাম।
তারপর হাসপাতাল থেকে বের হয়েই চাচা দাড়ালো। মোবাইলে অনেকক্ষণ টেপাটিপি করলো। এরপর কয়েক জায়গায় ফোন করলো। তার কথায় বুঝতে পারলাম পেপার অফিসে কথা বলছে। ফোন করে বলছে,ভাইজান ছবি পাঠালাম,শেষ পাতায় লাল বা বøু কালিতে বড় করে ছবিটা ছাপতে হবে।ওপার থেকে কি যে বললো, চাচা বললো,কোন সমস্যা হবে না,ডাবল কমালে দেন আমি আপনাকে ‘টেককেয়ার’ করবো। এই কথা বলে চাচা ফোন কেটে দিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি কি সুন্দর একটা তৃপ্তির হাসি,যে ক্রিকেট খেলে বিশ্ব জয় করে ফেলেছে।
চাচা-ভাজিতা নেতার সাথে তোমাকে যে ছবি তুলবার বললাম,তুমি যে ছবি তুলনা না। একখান ছবি তুলা রাখলে,ভবিষ্যতে যে কাজে লাগবে না, তার কোন গ্যারান্টি আছে ?
আমি বললাম,রোগীর পাশে যে তার বউ আর মেয়ে ছিল তাদের মুখটা দেখেছেন ?
চাচা বললো,সেটা তো খেয়াল করি নাই।
আমি বললাম, খেয়াল করার ইচ্ছা আপনার তো দেখলাম না চাাচা। আপনি তো ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে ছিলেন। ওই দুই মুখের দিকে তাকালে আপনি হয়তো ছবিই তুলতে চাইতেন না।
চাচা মুখটা ভার করে বলে,এই সমাজে টিকে থাকে হলে টেকনিকও লাগে। এই যে ছবি তুলে ফেসবুক আর পেপারে দেব, এটা যে আমার জন্য কত বড় অর্জন তা তুমি বুঝতে পারবা না ভাতিজা।
চাচা দেখছেন, আপনার লিডার যখন শুয়ে ছিল, তখন নি:শ্বাস নিতে কত কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর কোথাও কোন অক্সিজেন নাই,বাতাস শেষ হয়ে গেছে। যার জন্য অক্সিজেন বুকে টেনে নেয়ার জন্য জোরে জোরে নি:শ্বাস ছাড়ছে আর নিচ্ছে। বুকটা কামারের হাপরের মত উঠা নামা করছে। আর চোখ দুটা কষ্টে-বেদনায় ঠিকরে বের হচ্ছিল। চাচা,এত কষ্ট দেখে আমার অসহ্য লাগছিল।
-ভাতিজা সব কিছু বিবেক দিয়ে বিচার করা ঠিক হবে না। কোন কোন সময় টেকনিকের উপর দিয়েও চলতে হয়, কৌশলও থাকা লাগে। এই ছবি তুলে রাখলাম এটা একটা স্মৃতি হয়ে থাকলো।
-ছবিটা না হয় স্মৃতি হলো, কিন্ত এই যে শুনলাম ছবিগুলা ফেসবুকে আর পেপাওে দিচ্ছেন ?
-আরে ভাজিতা কিছু হতে গেলে প্রচারও লাগে! তোমার বয়স কম ,তাই এখনও অনেক কিছু বোঝ না। বিজ্ঞাপনে শোনেন নাই, প্রচারেই প্রসার। তা না হলে কি কমিউনিটিতে টিকা থাকা যাবে ? লিডার হওয়া যাবে ? ভাতিজা, নিউইয়র্কে এটা একটা ‘কালচার’ হয়েছে। ছবি তুলে ফেসবুক আর পেপারে দেওয়া বাঙালি কমিউনিটিতে ইতিহাস-ঐতিহ্য হয়ে দাড়িয়েছে। এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। দেখেন না..।
চাচার এমন উল্টাপাল্টা ‘লেকচার’ শোনা আমার রুচিতে বাঁধলো। এই কথা শুনে আমি তো একেবারে থ‘ মেরে গেলাম। কিন্ত মনে মনে ভাবতে লাগলাম,আসলেই কি রোগীর ছবি তুলে ফেসবুক আর পেপারে দেয়া কালচারে পরিনত হচ্ছে ! না বিকৃত চিন্তা ? অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা ?
হায় রে মানুষ ! হায় রে মানুষের বিবেক!