হাসান মাহমুদ
মানব পাচারের ঘটনা বাংলাদেশে কতটা প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে দৃষ্টি রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করতে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন বলেন, ‘মানব পাচারকারীরা ফাঁদে ফেলার জন্য অনলাইন কৌশল ব্যবহার করছে। তাদেরকে ধরার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সারা বিশ্বের ১০ জন এমন ব্যক্তিদের এবার অ্যাওয়ার্ড দেয়া হলো; যারা নিজনিজ দেশে মানব পাচার (হিউম্যান ট্র্যাফিকিং) প্রতিরোধে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের আল আমিন নয়ন অন্যতম। বাংলাদেশ থেকে আল আমিন নয়নকে পাচারকারীরা বিদেশে নিয়ে জিম্মি করেছিল। এক সময় তারা তাকে বিক্রি কওে দিয়েছিল। সেখান থেকে সে পালিয়ে এসে গত ১৫ বছর ধরে মানব পাচার প্রতিরোধমূলক কাজ করে পাচার হওয়া ৩৫ হাজার বাংলাদেশিকে সহযোগিতা দিয়েছে।’ ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে আসা বাংলাদেশের আল আমিন নয়নের হাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন ‘টিআইপি হিরো’ অ্যাওয়ার্ড তুলে দেবার সময় এসব কথা বলেন।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে ব্লিনকেন বলেন, ‘বাংলাদেশের আল আমিন নয়ন ২০০৭ সালে পাচারকারীদের শিকার হয়ে এক দু:খজনক জীবন কাটান। বন্দি অবস্থা থেকে ফিরে এসে পাচার হওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়ার পর বেঁচে যাওয়া হাজার হাজার বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করেছেন আল আমিন নয়ন। ব্লিনকেন বলেন, ‘হাজার হাজার বাংলাদেশি তার প্রচেষ্টার জন্য আজ কৃতজ্ঞ’।
বাংলাদেশের আল আমিন নয়ন অ্যাওয়ার্ড পাবার পর ‘সাপ্তাহিক আজকালে’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ফোনে বলেন, ‘আমি কোন দিন কল্পনাই করিনি এত বড় অ্যাওয়ার্ড পাব। এই প্রাপ্তি ভাষায় বোঝানো যাবে না। আমেরিকায় এবারই আমার প্রথম আসা। ওয়াশিংটনে আসার পর ইউএস অ্যাম্বেসেডর অ্যাট লার্জ এন্ড ট্র্যাফিকিং ইন পার্সন সিন্ডি ডায়ার মেডাম আমার অতীত ঘটনা শুনে বিস্মিত হয়ে যান। তিনি কমপক্ষে ৫০ মিনিট আমার বিভিষিকাময় জীবনের ঘটনা শুনেন। রাজশাহীর গোদাগাড়িতে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। টানাপোড়নের সংসার। জীবিকার সন্ধানে ২০০৭ সালে আমি একটি গ্রুপের মাধ্যমে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কোন কাজ পাইনি। এক রাতে কাজের কথা বলে তারা আরেকটি গ্রুপের কাছে আমাকে তুলে দেয়। পরে জানতে পারলাম প্রথম গ্রুপের আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে একটি তামিল গ্রুপের কাছে। রাতে তারা আমার মতো আরও কয়েকজনকে নিয়ে রওনা দেয়। গভীর রাতে আমাদের গাড়ীটি একটি গহীন জঙ্গলের পাশে গিয়ে থামে। হাত বাধা অবস্থায় হাঁটতে হয়েছে অনেক দূর। সেখানেই মানব পাচারকারীদের একটি সেলে আমি ৭ মাস বন্দি থেকে নির্যাতিত হয়েছি।’
বিশ্বে মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সন’ (টিআইপি) রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। ২০২৪ সালের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে আল আমিন নয়নকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিøংকেন বাংলাদেশে মানব পাচার প্রতিরোধে তার ভূমিকার প্রশংসা করেন। টিআইপি রিপোর্টে বলা হয়, ‘গত দুই দশকে মানব পাচারের বৈশ্বিক প্রবণতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপি পাচার হওয়া ২৭ মিলিয়ন মানুষকে দুই দশকে শ্রম ও বাণিজ্যিক যৌনতার কাজে ব্যবহার করেছে অপরাধি গোষ্ঠি’। ‘টিআইপি হিরো’ অ্যাওয়ার্ড সারা বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
২০২৪ সালের ২৪ জুনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের টিআইপি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকার পাচার নির্মূলের জন্য ন্যূনতম মানগুলি সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করে না। সরকার প্রথমবারের মতো পাচারের শিকার হওয়াদের ক্ষতিপূরণ তহবিলে অর্থ জমা করেছে। মানব পাচার করে দেশে বিদেশে বিক্রি করে থাকে অপরাধিরা। অপরাধমূলক জোরপূর্বক যৌন কাজে জড়িতদের মোকাবেলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। বরং মানব পাচারকে অভিবাসি চোরাচালানের সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে ১০ শতাংশের কম নারী স্বেচ্ছায় বাণিজ্যিক যৌন পল্লিতে যেয়ে
থাকে।’
গত বুধবার এই রিপোর্ট লেখার সময় আল আমিন নয়ন ফোনে জানিয়েছেন, ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাশ তাঁর অফিসে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সেখানে যান এবং তার অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি এবং যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতা তাঁদের সঙ্গে শেয়ার করেন। আল আমিন নয়ন ‘আজকাল’কে জানান, বাংলাদেশে মানবপাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। তা তিনি জানতেন না। প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় গত ডিসেম্বরে পুলিশ বিমানবন্দর থেকে তাকে ধরে আদালতে হাজির করলে বিচারক তাকে ঢাকার কেরানিগঞ্জের কারাগারে পাঠান। সেখানে ৮ দিন জেল খেটেছেন আল আমিন নয়ন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিøংকেন বলেন, ‘পাচারকারীদের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশের আল আমিন নয়নের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে। বেসরকারী খাত, নাগরিক সমাজ, বহুজাতিক সংস্থা এবং বেঁচে ফেরা মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হবে যারা জটিল চ্যালেঞ্জটি বুঝে। মানব পাচার এমন একটি সমস্যার নাম যা কোন একটি জাতি একা সমাধান করতে পারবে না।’
রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে মানব পাচারকারী নেটওয়ার্কগুলি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে, গেমিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অন লাইনে শিকারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। মানব পাচারকারীরা ভুক্তভোগিদের ফাঁদে ফেলার জন্য অন লাইন ব্যবহার করে। তাদের ধরার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টে মানব পাচার রিপোর্ট ‘টিআইপি’ প্রকাশের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন বলেন, মানব পাচারে জড়িত অপরাধিরা তাদের
পদ্ধতিগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। মানব পাচারের প্রবণতা এবং কৌশল ধরার জন্য মেশিন লার্নিং উদ্যোগের বিকাশ ঘটানো হয়েছে। দেশে দেশে মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্টেট ডিপার্টমেন্ট অন্যান্য সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ বছর বিশ্বজুড়ে মানব পাচার বিরোধি দশ দেশের ১০ জন ‘টিআইপি হিরো’কে সম্মানিত করেছে। দেশগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, স্পেন, বলিভিয়া, কেনিয়া, ইরাক, সার্বিয়া, মালি, কিউবা এবং জাম্বিয়া। তাদের মধ্যে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশের আল আমিন নয়ন ছিলেন একজন ভিকটিম। আল আমিন নয়ন মানবপাচার বিরোধি কাজ নিয়ে ঢাকায় ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে জানান।
##